বেলারুশ লেখক স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ সারা জীবন ধরে রচনা করেছেন একটি গ্রন্থ। সে গ্রন্থের সাধারণ শিরোনাম দিয়েছেন গালাসা স্ত্রানি উতোপিয়ি: ইউটোপিয়ার দেশের কণ্ঠস্বর। যে ইউটোপিয়ার কথা তিনি বলেছেন, তাঁর বিবেচনায়, সেটা কমিউনিজম। আর সেই ইউটোপিয়ার দেশটার নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন, যা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেছে দুই যুগ আগে। বলা হয়, তারপর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী এই দুই যুগে সুইডিশ নোবেল কমিটি এমন কোনো লেখককে পুরস্কৃত করেনি, যিনি ‘ইউটোপিয়ার দেশের’ শাসকদের তৈরি করা ইতিহাসের পাল্টা ভাষ্য দাঁড় করিয়েছেন। স্ফেতলানা আলেক্সিয়েভিচের নোবেল পুরস্কার পাওয়া তাই একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। তিনি বহু মানুষের কণ্ঠস্বর সযত্নে সংকলিত করে ইউটোপিয়ার দেশের ইতিহাসের যে ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন, তা ইউটোপিয়া-শাসকদের ভাষ্যকে প্রতিহত করতে চায়।
এদিক থেকে তাঁর নোবেল বিজয়কে একটা রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখা যায়। তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সাংবাদিকেরা তাঁকে এমন কথা বলতে প্ররোচিত করেছেন যে তিনি পুতিন ও তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুর রাশিয়াকে পছন্দ করেন না; ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপকে তিনি মনে করেন ‘দখলদারি’, ‘বিদেশি আগ্রাসন’।
আলেক্সিয়েভিচের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ব্যতিক্রমী দিক আরও আছে: এ পুরস্কার সাধারণত যাঁরা পেয়ে থাকেন, তিনি তাঁদের মতো কবি, কথাসাহিত্যিক বা নাট্যকার নন। তিনি একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, একজন নন-ফিকশন লেখক। ইউটোপিয়ার দেশের কণ্ঠস্বর গ্রন্থলহরীর যে পাঁচটি খণ্ড তিনি এ পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন, সেগুলো নন-ফিকশন। আমার জানামতে, নন-ফিকশন লিখে এর আগে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন, তাঁরা সবাই পুরুষ: থিওডর মমসেন, উইনস্টন চার্চিল ও বার্ট্রান্ড রাসেল। স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচই প্রথম নারী নন-ফিকশন লেখক, যিনি এই পুরস্কার পেলেন। তাঁর মা ইউক্রেনীয়, বাবা বেলারুশ; জন্মেছেন সোভিয়েত ইউক্রেনে আর এখন তিনি স্বাধীন বেলারুশ প্রজাতন্ত্রের নাগরিক, বাস করেন দেশটির রাজধানী মিনস্ক-এ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নোবেলবিজয়ী এই ‘বেলারুশ লেখক’ মাতৃভাষা বেলারুশিতে লিখতে জানেন না, লেখেন রুশ ভাষায়। এটাও আরেক ব্যতিক্রম: রুশ ভাষার যে পাঁচজন কবি-ঔপন্যাসিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন পুরুষ। স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ প্রথম নারী রুশভাষী লেখক, যিনি নোবেল পেলেন।
লিখনশৈলীর দিক থেকেও তিনি অন্য রকমের: তাঁর নন-ফিকশনগুলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নয়, তথ্য-উপাত্তে ভরা বিশ্লেষণী প্রবন্ধ নয়, মাঠপর্যায়ের গবেষণা-সমীক্ষা নয়। সেগুলো নিখাদ গল্প: বাস্তব স্থানে ও কালে অস্তিত্বমান জীবন্ত মানুষের কণ্ঠে বর্ণিত সত্য কাহিনি। ইউটোপিয়ার দেশের কণ্ঠস্বর গ্রন্থলহরীর প্রথম পুস্তক উ ভাইনি নি ঝেনস্কোয়ে লিৎসো (যুদ্ধের চেহারা মেয়েলি নয়) তিনি লিখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সোভিয়েত নারীদের বলা কাহিনি সংকলিত করে। পুরো বইটাই ভিন্ন ভিন্ন নারীর স্বতগকথন (মনোলগ)। দ্বিতীয় বই পাসলেদনিয়ে স্ভিদিতেলি: স্তো নিদেৎস্কিখ রাসকাজোভ (শেষ সাক্ষীগণ: ১০০ অ-শিশুতোষ গল্প) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৬ থেকে ১২ বছর বয়স ছিল এমন এক শ জন মানুষের বলা কাহিনির সংকলন। তৃতীয় বই সিনকোভিয়ে মালচিকি (দস্তায় মোড়া ছেলেরা) লিখেছেন আফগানিস্তানে সোভিয়েত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা ও তাদের মায়েদের বলা কাহিনির সংকলনে। আফগানিস্তানের যুদ্ধে যেসব সোভিয়েত যোদ্ধা মারা যেত, তাদের লাশ তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হতো দস্তার তৈরি কফিনে করে। সে জন্যই এ বইয়ের এমন শিরোনাম। চতুর্থ বইটি লিখেছেন চেরনোবিল পরমাণু শক্তিকেন্দ্রের দুর্ঘটনার শিকার মানুষদের বলা গল্প নিয়ে: চেরনোবিলস্কায়া মালিৎভা: খ্রনিকা বুদুশেভা (চেরনোবিলের প্রার্থনা: ভবিষ্যতের ক্রনিকল)। পঞ্চম বই ভ্রেমিয়া সেকন্ড-খেন্দ (সেকেন্ড হ্যান্ড সময়) সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিনগুলো ও তার পরের সময় নিয়ে বহু মানুষের বলা কাহিনির সংকলন।
বইগুলোর বিষয়বস্তু থেকে স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের লেখার বিশেষত্ব, কিংবা লেখালেখি সম্পর্কে তাঁর দর্শন অনুধাবন করা যাবে না। সে জন্য প্রয়োজন হবে বইগুলো পড়ার। তাঁর লেখার কারিগরি পদ্ধতি সম্পর্কে এটা জানতে পারলাম যে তাঁর প্রধান সহায়ক যন্ত্র টেপরেকর্ডার। একেকটি বই লেখার জন্য তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পাঁচ শ থেকে সাত শ মানুষের। প্রতিটি বইয়ের পেছনে তাঁর ব্যয় হয়েছে চার থেকে সাত বছর পর্যন্ত। চেরনোবিল নিয়ে লেখা বইটার পেছনে গেছে ১০ বছর।
কিন্তু এগুলো তাঁর সৃজনকর্মের মূল কথা নয়। এসবের পেছনে আছে লেখালেখি সম্পর্কে তাঁর স্বকীয় দর্শন। নিজের ওয়েবসাইটের শুরুতেই তিনি লিখেছেন: আমি দীর্ঘ সময় ধরে লেখার এমন একটা ধরন (জঁর) খুঁজেছি, যা আমার বিশ্ববীক্ষা সঠিকভাবে প্রকাশের উপযোগী হবে। আমার চোখ, আমার কান যেভাবে তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটা পদ্ধতি আমি খুঁজেছি...আমি বেছে নিয়েছি মানুষের কণ্ঠস্বরের জঁর...আমি আমার বইগুলোকে দেখতে ও শুনতে পাই রাস্তায়, জানালার ওপাশে; সেখানে বাস্তবের মানুষেরা নিজেদের সময়ের প্রধান ঘটনাগুলো নিয়ে গল্পগুজব করছে: যুদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের পতন, চেরনোবিল; সম্মিলিতভাবে তারা তাদের কথায় রেখে যাচ্ছে দেশের ইতিহাস, সবার ইতিহাস। পুরোনো দেশের ও নতুন দেশের ইতিহাস। আর প্রত্যেকে রেখে যাচ্ছে নিজ নিজ ছোট ছোট মানবিক নিয়তির ইতিহাস। আজ, যখন পৃথিবী ও ব্যক্তি-মানুষের চেহারা ও স্বরূপ হয়েছে এত বৈচিত্র্যময় (এ ক্ষেত্রে শিল্প প্রায়ই নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে), আর শিল্পে প্রামাণ্যতা নিয়ে আগ্রহ আরও বাড়ছে, তখন প্রামাণ্যতা ছাড়া পৃথিবীর পূর্ণাঙ্গ ছবি উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।...বিশ বছরের বেশি সময় ধরে প্রামাণ্য উপাদান নিয়ে কাজ করে, পাঁচটি বই লেখার পুরোটা সময় ধরে আমি নিশ্চিত ছিলাম এবং বারবার বলেছি, আবারও বলছি: শিল্প মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারে না, বুঝতে পারে না...কিন্তু আমি বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার শুষ্ক, নিরাভরণ ইতিহাস লিখি না, আমি লিখি অনুভূতির ইতিহাস। এটাকে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসও বলা যায়। ঘটনার সময় ব্যক্তি-মানুষের ভাবনাগুলো কী ছিল, কী সে বুঝেছিল, কী তার মনে গেঁথে গিয়েছিল? কী সে বিশ্বাস করত, কিসে ছিল তার অবিশ্বাস, তার মোহ, স্বপ্ন, আশাগুলো কী ছিল? নিজের সম্পর্কে ও পৃথিবী সম্পর্কে সে কী বুঝেছিল...এটা এমন বিষয়, যা কল্পনা করা যায় না, বানিয়ে তোলা যায় না; অন্ততপক্ষে এই মাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ, বিশ্বাসযোগ্য ডিটেল কল্পনা করে বানিয়ে তোলা সম্ভব নয়।
মিখাইল বাখতিন সাহিত্যে পলিফোনি বা বহুস্বরের কথা বলে গেছেন। পলিফোনিক নভেল বা বহুস্বর উপন্যাসের সেরা দৃষ্টান্ত তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন দস্তইয়েফেস্কির উপন্যাসে। স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছে তাঁর ‘পলিফোনিক রাইটিংস’-এর কথা। আমেরিকান লেখক, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লাভিক ভাষার পিএইচডি গবেষক সোফি পিঙ্কহ্যাম আলেক্সিয়েভিচকে বর্ণনা করেছেন নন-ফিকশনের দস্তইয়েফস্কি হিসেবে। নিউ রিপাবলিক পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, আলেক্সিয়েভিচের ওপর দস্তইয়েফস্কির প্রভাব সুস্পষ্ট। আমিও তাঁর লেখায় দস্তইয়েফস্কির উল্লেখ বেশ কয়েকবার লক্ষ করেছি। সোফি পিঙ্কহ্যাম লিখেছেন, দস্তইয়েফস্কির মতো আলেক্সিয়েভিচও বিশ্বাস করেন যে মানবসভ্যতার সবচেয়ে আশার বিষয় হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ও প্রতিশোধ-পরায়ণতা ত্যাগ করা। দস্তইয়েফস্কির মতো আলেক্সিয়েভিচের গদ্যও ‘আর্টলেস’ বা শিল্পহীন। আমাদের সামনে সত্য উপস্থাপনের জন্য তিনিও দস্তইয়েফস্কির মতো বেছে নেন বহু মানুষের কণ্ঠস্বর। দস্তইয়েফস্কির মতো তিনিও শুধু নির্দিষ্ট স্থানে ও কালে অস্তিত্বমান ব্যক্তি-মানুষের কাহিনি নিয়ে আগ্রহী নন, বরং তিনি মানুষের মধ্যে খোঁজেন মানুষের প্রকৃত স্বরূপ। এই প্রসঙ্গ আলেক্সিয়েভিচের নিজের লেখাতেও আছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিভীষিকাময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে কতটা প্রকৃত মানুষ রয়ে গেছে, সেটাও তিনি খুঁজে দেখার ও বোঝার চেষ্টা করেন।
সাধারণ মানুষের নিজেদের বয়ানে তিনি যেসব গল্প বলেছেন, সেগুলোর সবই বিভীষিকাময়। রুশ দৈনিক ইজভেস্তিয়া তাঁকে বলেছে ‘বিভীষিকার এনসাইক্লোপিডিয়া রচয়িতা’। পত্রিকাটি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনি কেন এটা করেন? উত্তরে তিনি বলেছেন, যাতে এসব বিভীষিকার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। মানুষ যেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়। তিনি মনে করেন, অতীত ভুলে গেলে মানুষ একই বিভীষিকা বারবার সৃষ্টি করে। তাই তিনি বহু মানুষের কণ্ঠস্বরের উচ্চারণে অতীতের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে চান। তিনি মনে করেন, যে মানুষের অতীতের স্মৃতি নেই, সে কেবলই অশুভ কাজ করে।
আলেক্সিয়েভিচ প্রামাণ্য নন-ফিকশন লিখেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে ‘শিল্প’ মানুষ ও পৃথিবীকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে; তিনি মনে করেন নভেল বা উপন্যাস মানুষ ও তার জগৎকে যথাযথভাবে, বাস্তব, পূর্ণাঙ্গ সত্যরূপে উপস্থাপনের যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু তিনি নিজেই দাবি করেন, তাঁর বইগুলো কণ্ঠস্বরের উপন্যাস (নভেল অব ভয়েসেস)। প্যারিস রিভিউ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক, দ্য নিউ ইয়র্কার-এর স্টাফ রাইটার ফিলিপ গুরেভিচ মনে করেন, স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ নন-ফিকশন লিখলেও একজন শক্তিমান শিল্পী। মূল রুশ ভাষায় আলেক্সিয়েভিচের বইগুলোর অংশবিশেষ পড়ে আমিও দেখতে পেয়েছি, তাঁর ভাষাশৈলী দৃশ্যত সরল, নিরাভরণ ও প্রচলিত অর্থে ‘আর্টলেস’ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। ঘটনা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর মুনশিয়ানা অসাধারণ। যদিও তিনি দাবি করেন, তিনি বিভিন্ন মানুষের নিজের বয়ান টেপরেকর্ডার থেকে কাগজে লিখেছেন মাত্র, তবু এটা বোঝা মোটেও কঠিন নয় যে বয়ানগুলোর ভাষাশৈলী আসলে লেখকের নিজের। বিভিন্ন এলাকার, বিভিন্ন শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা-ডায়ালেক্টের মানুষের টেপরেকর্ডারে ধারণ করা কথা হুবহু কাগজে লিখলে যা পাওয়া যায়, তা যদি অবিকৃতভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে সেখানে বিশৃঙ্খলা ও অস্পষ্টতা স্বাভাবিকভাবেই থেকে যায়। কিন্তু আলেক্সিয়েভিচের কোনো বইতেই তা একদম নেই। সব স্বগতকথন তিনি লিখেছেন প্রমিত রুশ ভাষায়, কোনো অঞ্চলের কোনো অ্যাকসেন্ট কারও মনোলগেই নেই। তাঁর বইগুলোর সব স্বগতকথন একজন নিপুণ কথাশিল্পীর হাতে রচিত। সেই কথাশিল্পীর গদ্যশৈলী অনেকটা আন্তন চেখভের মতো স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জল।
আরও যা লক্ষ করার বিষয়, তাঁর সংকলিত বহুস্বরের মধ্যে তাঁর নিজের একটা স্বর আছে। এই স্বর শিল্পীর, ইতিহাসবিদের, সমাজ-মনস্তাত্ত্বিকের, সর্বোপরি একজন উপদেশপ্রবণ দার্শনিকের। তিনি শুধু অজস্র মানুষের কণ্ঠে তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা-অনুভূতির বয়ান সংকলন করেই কর্তব্য শেষ করেন না। তাঁর নিজেরও কিছু বলার আছে। তিনি বলতে চান, এভাবে জীবন যাপন করা ঠিক নয়। তিনি বলতে চান, মানুষকে জীবন দান করা হয়েছে সুখী হওয়ার জন্য, পরস্পরকে ভালোবাসার জন্য, কোনো কারণেই পরস্পরকে হত্যা করার জন্য নয়। তিনি বলতে চান, অতীত ভুলে যাওয়া উচিত নয়, কারণ অতীতের আলোয় ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, সমাজতন্ত্র, বা অন্য যেকোনো ভাবাদর্শের জন্য মানুষকে হত্যা করা কি নৈতিক? এবং নিজেই উত্তরে বলেন, না, নৈতিক নয়।
যদি মনে করা হয়, স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের লেখা বইগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের ইউটোপিয়ার নির্মাতা ও রক্ষাকারীদের (ব্যর্থ) তৈরি করা ইতিহাসের ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে—শুধু এটাই তাঁর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার করার কারণ, তাহলে ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কাজ নির্দিষ্ট স্থান-কালের ইতিহাসের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে প্রামাণ্য চিরন্তন মানবিক দলিল। prothom alo
এদিক থেকে তাঁর নোবেল বিজয়কে একটা রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখা যায়। তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সাংবাদিকেরা তাঁকে এমন কথা বলতে প্ররোচিত করেছেন যে তিনি পুতিন ও তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুর রাশিয়াকে পছন্দ করেন না; ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপকে তিনি মনে করেন ‘দখলদারি’, ‘বিদেশি আগ্রাসন’।
আলেক্সিয়েভিচের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ব্যতিক্রমী দিক আরও আছে: এ পুরস্কার সাধারণত যাঁরা পেয়ে থাকেন, তিনি তাঁদের মতো কবি, কথাসাহিত্যিক বা নাট্যকার নন। তিনি একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, একজন নন-ফিকশন লেখক। ইউটোপিয়ার দেশের কণ্ঠস্বর গ্রন্থলহরীর যে পাঁচটি খণ্ড তিনি এ পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন, সেগুলো নন-ফিকশন। আমার জানামতে, নন-ফিকশন লিখে এর আগে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন, তাঁরা সবাই পুরুষ: থিওডর মমসেন, উইনস্টন চার্চিল ও বার্ট্রান্ড রাসেল। স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচই প্রথম নারী নন-ফিকশন লেখক, যিনি এই পুরস্কার পেলেন। তাঁর মা ইউক্রেনীয়, বাবা বেলারুশ; জন্মেছেন সোভিয়েত ইউক্রেনে আর এখন তিনি স্বাধীন বেলারুশ প্রজাতন্ত্রের নাগরিক, বাস করেন দেশটির রাজধানী মিনস্ক-এ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নোবেলবিজয়ী এই ‘বেলারুশ লেখক’ মাতৃভাষা বেলারুশিতে লিখতে জানেন না, লেখেন রুশ ভাষায়। এটাও আরেক ব্যতিক্রম: রুশ ভাষার যে পাঁচজন কবি-ঔপন্যাসিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন পুরুষ। স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ প্রথম নারী রুশভাষী লেখক, যিনি নোবেল পেলেন।
লিখনশৈলীর দিক থেকেও তিনি অন্য রকমের: তাঁর নন-ফিকশনগুলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নয়, তথ্য-উপাত্তে ভরা বিশ্লেষণী প্রবন্ধ নয়, মাঠপর্যায়ের গবেষণা-সমীক্ষা নয়। সেগুলো নিখাদ গল্প: বাস্তব স্থানে ও কালে অস্তিত্বমান জীবন্ত মানুষের কণ্ঠে বর্ণিত সত্য কাহিনি। ইউটোপিয়ার দেশের কণ্ঠস্বর গ্রন্থলহরীর প্রথম পুস্তক উ ভাইনি নি ঝেনস্কোয়ে লিৎসো (যুদ্ধের চেহারা মেয়েলি নয়) তিনি লিখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সোভিয়েত নারীদের বলা কাহিনি সংকলিত করে। পুরো বইটাই ভিন্ন ভিন্ন নারীর স্বতগকথন (মনোলগ)। দ্বিতীয় বই পাসলেদনিয়ে স্ভিদিতেলি: স্তো নিদেৎস্কিখ রাসকাজোভ (শেষ সাক্ষীগণ: ১০০ অ-শিশুতোষ গল্প) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৬ থেকে ১২ বছর বয়স ছিল এমন এক শ জন মানুষের বলা কাহিনির সংকলন। তৃতীয় বই সিনকোভিয়ে মালচিকি (দস্তায় মোড়া ছেলেরা) লিখেছেন আফগানিস্তানে সোভিয়েত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা ও তাদের মায়েদের বলা কাহিনির সংকলনে। আফগানিস্তানের যুদ্ধে যেসব সোভিয়েত যোদ্ধা মারা যেত, তাদের লাশ তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হতো দস্তার তৈরি কফিনে করে। সে জন্যই এ বইয়ের এমন শিরোনাম। চতুর্থ বইটি লিখেছেন চেরনোবিল পরমাণু শক্তিকেন্দ্রের দুর্ঘটনার শিকার মানুষদের বলা গল্প নিয়ে: চেরনোবিলস্কায়া মালিৎভা: খ্রনিকা বুদুশেভা (চেরনোবিলের প্রার্থনা: ভবিষ্যতের ক্রনিকল)। পঞ্চম বই ভ্রেমিয়া সেকন্ড-খেন্দ (সেকেন্ড হ্যান্ড সময়) সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিনগুলো ও তার পরের সময় নিয়ে বহু মানুষের বলা কাহিনির সংকলন।
বইগুলোর বিষয়বস্তু থেকে স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের লেখার বিশেষত্ব, কিংবা লেখালেখি সম্পর্কে তাঁর দর্শন অনুধাবন করা যাবে না। সে জন্য প্রয়োজন হবে বইগুলো পড়ার। তাঁর লেখার কারিগরি পদ্ধতি সম্পর্কে এটা জানতে পারলাম যে তাঁর প্রধান সহায়ক যন্ত্র টেপরেকর্ডার। একেকটি বই লেখার জন্য তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পাঁচ শ থেকে সাত শ মানুষের। প্রতিটি বইয়ের পেছনে তাঁর ব্যয় হয়েছে চার থেকে সাত বছর পর্যন্ত। চেরনোবিল নিয়ে লেখা বইটার পেছনে গেছে ১০ বছর।
কিন্তু এগুলো তাঁর সৃজনকর্মের মূল কথা নয়। এসবের পেছনে আছে লেখালেখি সম্পর্কে তাঁর স্বকীয় দর্শন। নিজের ওয়েবসাইটের শুরুতেই তিনি লিখেছেন: আমি দীর্ঘ সময় ধরে লেখার এমন একটা ধরন (জঁর) খুঁজেছি, যা আমার বিশ্ববীক্ষা সঠিকভাবে প্রকাশের উপযোগী হবে। আমার চোখ, আমার কান যেভাবে তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটা পদ্ধতি আমি খুঁজেছি...আমি বেছে নিয়েছি মানুষের কণ্ঠস্বরের জঁর...আমি আমার বইগুলোকে দেখতে ও শুনতে পাই রাস্তায়, জানালার ওপাশে; সেখানে বাস্তবের মানুষেরা নিজেদের সময়ের প্রধান ঘটনাগুলো নিয়ে গল্পগুজব করছে: যুদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের পতন, চেরনোবিল; সম্মিলিতভাবে তারা তাদের কথায় রেখে যাচ্ছে দেশের ইতিহাস, সবার ইতিহাস। পুরোনো দেশের ও নতুন দেশের ইতিহাস। আর প্রত্যেকে রেখে যাচ্ছে নিজ নিজ ছোট ছোট মানবিক নিয়তির ইতিহাস। আজ, যখন পৃথিবী ও ব্যক্তি-মানুষের চেহারা ও স্বরূপ হয়েছে এত বৈচিত্র্যময় (এ ক্ষেত্রে শিল্প প্রায়ই নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে), আর শিল্পে প্রামাণ্যতা নিয়ে আগ্রহ আরও বাড়ছে, তখন প্রামাণ্যতা ছাড়া পৃথিবীর পূর্ণাঙ্গ ছবি উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।...বিশ বছরের বেশি সময় ধরে প্রামাণ্য উপাদান নিয়ে কাজ করে, পাঁচটি বই লেখার পুরোটা সময় ধরে আমি নিশ্চিত ছিলাম এবং বারবার বলেছি, আবারও বলছি: শিল্প মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারে না, বুঝতে পারে না...কিন্তু আমি বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার শুষ্ক, নিরাভরণ ইতিহাস লিখি না, আমি লিখি অনুভূতির ইতিহাস। এটাকে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসও বলা যায়। ঘটনার সময় ব্যক্তি-মানুষের ভাবনাগুলো কী ছিল, কী সে বুঝেছিল, কী তার মনে গেঁথে গিয়েছিল? কী সে বিশ্বাস করত, কিসে ছিল তার অবিশ্বাস, তার মোহ, স্বপ্ন, আশাগুলো কী ছিল? নিজের সম্পর্কে ও পৃথিবী সম্পর্কে সে কী বুঝেছিল...এটা এমন বিষয়, যা কল্পনা করা যায় না, বানিয়ে তোলা যায় না; অন্ততপক্ষে এই মাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ, বিশ্বাসযোগ্য ডিটেল কল্পনা করে বানিয়ে তোলা সম্ভব নয়।
মিখাইল বাখতিন সাহিত্যে পলিফোনি বা বহুস্বরের কথা বলে গেছেন। পলিফোনিক নভেল বা বহুস্বর উপন্যাসের সেরা দৃষ্টান্ত তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন দস্তইয়েফেস্কির উপন্যাসে। স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছে তাঁর ‘পলিফোনিক রাইটিংস’-এর কথা। আমেরিকান লেখক, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লাভিক ভাষার পিএইচডি গবেষক সোফি পিঙ্কহ্যাম আলেক্সিয়েভিচকে বর্ণনা করেছেন নন-ফিকশনের দস্তইয়েফস্কি হিসেবে। নিউ রিপাবলিক পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, আলেক্সিয়েভিচের ওপর দস্তইয়েফস্কির প্রভাব সুস্পষ্ট। আমিও তাঁর লেখায় দস্তইয়েফস্কির উল্লেখ বেশ কয়েকবার লক্ষ করেছি। সোফি পিঙ্কহ্যাম লিখেছেন, দস্তইয়েফস্কির মতো আলেক্সিয়েভিচও বিশ্বাস করেন যে মানবসভ্যতার সবচেয়ে আশার বিষয় হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ও প্রতিশোধ-পরায়ণতা ত্যাগ করা। দস্তইয়েফস্কির মতো আলেক্সিয়েভিচের গদ্যও ‘আর্টলেস’ বা শিল্পহীন। আমাদের সামনে সত্য উপস্থাপনের জন্য তিনিও দস্তইয়েফস্কির মতো বেছে নেন বহু মানুষের কণ্ঠস্বর। দস্তইয়েফস্কির মতো তিনিও শুধু নির্দিষ্ট স্থানে ও কালে অস্তিত্বমান ব্যক্তি-মানুষের কাহিনি নিয়ে আগ্রহী নন, বরং তিনি মানুষের মধ্যে খোঁজেন মানুষের প্রকৃত স্বরূপ। এই প্রসঙ্গ আলেক্সিয়েভিচের নিজের লেখাতেও আছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিভীষিকাময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে কতটা প্রকৃত মানুষ রয়ে গেছে, সেটাও তিনি খুঁজে দেখার ও বোঝার চেষ্টা করেন।
সাধারণ মানুষের নিজেদের বয়ানে তিনি যেসব গল্প বলেছেন, সেগুলোর সবই বিভীষিকাময়। রুশ দৈনিক ইজভেস্তিয়া তাঁকে বলেছে ‘বিভীষিকার এনসাইক্লোপিডিয়া রচয়িতা’। পত্রিকাটি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনি কেন এটা করেন? উত্তরে তিনি বলেছেন, যাতে এসব বিভীষিকার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। মানুষ যেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়। তিনি মনে করেন, অতীত ভুলে গেলে মানুষ একই বিভীষিকা বারবার সৃষ্টি করে। তাই তিনি বহু মানুষের কণ্ঠস্বরের উচ্চারণে অতীতের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে চান। তিনি মনে করেন, যে মানুষের অতীতের স্মৃতি নেই, সে কেবলই অশুভ কাজ করে।
আলেক্সিয়েভিচ প্রামাণ্য নন-ফিকশন লিখেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে ‘শিল্প’ মানুষ ও পৃথিবীকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে; তিনি মনে করেন নভেল বা উপন্যাস মানুষ ও তার জগৎকে যথাযথভাবে, বাস্তব, পূর্ণাঙ্গ সত্যরূপে উপস্থাপনের যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু তিনি নিজেই দাবি করেন, তাঁর বইগুলো কণ্ঠস্বরের উপন্যাস (নভেল অব ভয়েসেস)। প্যারিস রিভিউ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক, দ্য নিউ ইয়র্কার-এর স্টাফ রাইটার ফিলিপ গুরেভিচ মনে করেন, স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ নন-ফিকশন লিখলেও একজন শক্তিমান শিল্পী। মূল রুশ ভাষায় আলেক্সিয়েভিচের বইগুলোর অংশবিশেষ পড়ে আমিও দেখতে পেয়েছি, তাঁর ভাষাশৈলী দৃশ্যত সরল, নিরাভরণ ও প্রচলিত অর্থে ‘আর্টলেস’ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। ঘটনা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর মুনশিয়ানা অসাধারণ। যদিও তিনি দাবি করেন, তিনি বিভিন্ন মানুষের নিজের বয়ান টেপরেকর্ডার থেকে কাগজে লিখেছেন মাত্র, তবু এটা বোঝা মোটেও কঠিন নয় যে বয়ানগুলোর ভাষাশৈলী আসলে লেখকের নিজের। বিভিন্ন এলাকার, বিভিন্ন শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা-ডায়ালেক্টের মানুষের টেপরেকর্ডারে ধারণ করা কথা হুবহু কাগজে লিখলে যা পাওয়া যায়, তা যদি অবিকৃতভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে সেখানে বিশৃঙ্খলা ও অস্পষ্টতা স্বাভাবিকভাবেই থেকে যায়। কিন্তু আলেক্সিয়েভিচের কোনো বইতেই তা একদম নেই। সব স্বগতকথন তিনি লিখেছেন প্রমিত রুশ ভাষায়, কোনো অঞ্চলের কোনো অ্যাকসেন্ট কারও মনোলগেই নেই। তাঁর বইগুলোর সব স্বগতকথন একজন নিপুণ কথাশিল্পীর হাতে রচিত। সেই কথাশিল্পীর গদ্যশৈলী অনেকটা আন্তন চেখভের মতো স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জল।
আরও যা লক্ষ করার বিষয়, তাঁর সংকলিত বহুস্বরের মধ্যে তাঁর নিজের একটা স্বর আছে। এই স্বর শিল্পীর, ইতিহাসবিদের, সমাজ-মনস্তাত্ত্বিকের, সর্বোপরি একজন উপদেশপ্রবণ দার্শনিকের। তিনি শুধু অজস্র মানুষের কণ্ঠে তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা-অনুভূতির বয়ান সংকলন করেই কর্তব্য শেষ করেন না। তাঁর নিজেরও কিছু বলার আছে। তিনি বলতে চান, এভাবে জীবন যাপন করা ঠিক নয়। তিনি বলতে চান, মানুষকে জীবন দান করা হয়েছে সুখী হওয়ার জন্য, পরস্পরকে ভালোবাসার জন্য, কোনো কারণেই পরস্পরকে হত্যা করার জন্য নয়। তিনি বলতে চান, অতীত ভুলে যাওয়া উচিত নয়, কারণ অতীতের আলোয় ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, সমাজতন্ত্র, বা অন্য যেকোনো ভাবাদর্শের জন্য মানুষকে হত্যা করা কি নৈতিক? এবং নিজেই উত্তরে বলেন, না, নৈতিক নয়।
যদি মনে করা হয়, স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের লেখা বইগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের ইউটোপিয়ার নির্মাতা ও রক্ষাকারীদের (ব্যর্থ) তৈরি করা ইতিহাসের ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে—শুধু এটাই তাঁর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার করার কারণ, তাহলে ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কাজ নির্দিষ্ট স্থান-কালের ইতিহাসের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে প্রামাণ্য চিরন্তন মানবিক দলিল। prothom alo
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন