বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

শরণার্থী সমস্যা আরব দেশগুলো কেন নিদায় নীরব?


  .ভূমধ্যসাগরতীরে মানবতার করুণ উপাখ্যান রচিত হচ্ছে প্রতিদিন। হাঙ্গেরিতেও কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটার বাহু কেটে রক্তাক্ত হলেও সীমান্তরক্ষীরা শুনবে বলে সে একটুও কাঁদেনি। গর্ব করে তার বাবা বলেন, আমার ছেলেটা বীর। সাগরতীরে আয়লান কুর্দির লাশ হৃদয় ভেঙে দেয়, সৌদি আরব ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর উদাসীনতার দুর্গ তবু ভাঙে না।
৪০ লাখের বেশি সিরীয় দেশ থেকে দেশে, সীমান্ত থেকে সীমান্তে আশ্রয়ের সন্ধানে ভুগছে ও ছুটছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব একযোগে নির্বিকার। সভ্যতার আঁতুড়ঘর বলা হতো ইরাক ও সিরিয়াকে। এখন তারা বধ্যভূমি। এখন খবর বের হচ্ছে আইএস তাদেরই সৃষ্টি। আর আইএস সৃষ্টি করছে লাখ লাখ উদ্বাস্তু। পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট জঙ্গিরা পৃথিবীতেই দোজখের মডেল দেখাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবেও
আরব ধনকুবেরদের দানে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী এসব ধ্বংসের কারিগর। তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া সিরীয় ওমর হারিরির কণ্ঠে তাই তিক্ত হতাশা, ‘তারা বিদ্রোহীদের সাহায্য করে, শরণার্থীদের দেখে না।’
উপসাগরীয় সালতানাতগুলো বিশ্বের শীর্ষ ধনী, অথচ শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ। যে কুয়েতিরা ১৯৯০ সালে ইরাকি হামলায় শরণার্থী হয়েছিল, সিরীয় শরণার্থীরা তাদের চোখে ‘ভিন্ন, আতঙ্কগ্রস্ত ও মানসিকভাবে অসুস্থ, আমাদের জীবনধারায় তারা বেমানান!’ ইরাক আক্রমণের পক্ষে জর্জ বুশের যুক্তিও ছিল এমন: তারা আমাদের জীবনধারা ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু ভোগবিলাসে মত্ত থেকে স্বজাতি, স্বধর্মের আরবদের জীবন তছনছ করা কেমন সুস্থতা? ওদিকে ইয়েমেনে হামলা করে করে উদ্বাস্তুর ঢল প্রতিদিন বাড়িয়ে চলেছে সৌদি আরব। আরব উপদ্বীপ ও উপসাগরীয় দেশগুলোয় একজন সিরীয়ও আশ্রয় পায়নি। বরং আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে বলায় আরব আমিরাত থেকে এক ফিলিস্তিনি ব্লগারকে বহিষ্কার করা হয়।
সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করায় তুরস্কের ভূমিকাও কম নয়। তারপরও দেশটির ২০ লাখ আশ্রিত মানুষের মধ্যে ১৭ লাখ সিরীয় ও এক লাখ ইরাকি। লেবাননের প্রতি পাঁচজনের একজন সিরীয়। ইরাকেও আশ্রয় নিয়েছে আড়াই লাখ সিরীয়। আরবদের মধ্যে মিসর ও জর্ডানে রয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৩০ হাজার ও ৬৩ হাজার সিরীয়। তিউনিসিয়ায় রয়েছে ২২ লাখ লিবীয়। আলজেরিয়ায় আছে ৫৫ হাজার।
শরণার্থীদের ডুবন্ত হাত যখন আরব শাসকেরা ফিরিয়ে দেয়, তখনই অগতির গতি হয় ইউরোপ। এ বছর ভূমধ্যসাগর পেরিয়েছে সাড়ে তিন লাখ শরণার্থী, এদের ২ হাজার ৬০০ জনের সলিলসমাধি ঘটেছে। গত সপ্তাহে অস্ট্রিয়ায় এক লরির ভেতর ৭১ জনের গলিত লাশ মেলে। তুরস্কের উপকূলে শিশু আয়লানের মৃত্যুদৃশ্যের অভিঘাতে পরদিনই জার্মানি সীমান্ত খুলে দেয়। তিন বছরের সেই শিশুটিই হয়ে ওঠে মানবতার আপন সন্তান। ইউরোপীয় বিবেক নড়ে ওঠে। নিজেদের হাতেও রক্ত ও কালিমার দাগ দেখে বিব্রত হয় তারা। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অভিবাসনকামীদের ‘পঙ্গপাল’ বললেও জনমতের চাপে দ্রুত অবস্থান বদলান। অথচ আরব িলগ, ওআইসি ও জিসিসি যেন অবশ। এ দেশগুলোর কোনোটিই শরণার্থীর অধিকার–বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি।
সৌদি আরবের অবস্থান তবু বদলায় না। আরব বসন্তের পর থেকে শিয়া, ফিলিস্তিনি ও সিরীয়দের আশ্রয় দেওয়ায় সেখানে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাদের ভয়, এরা রাজতান্ত্রিক দুঃশাসন মানবে না বেশি দিন। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত একজন শরণার্থীকেও আশ্রয় না দেওয়াকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ‘চরম লজ্জাজনক’ আখ্যা দেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মুখপাত্রের ভাষায়, ‘দায়ের অংশীদার তারা হতে চায় না, তারা চায় অন্যরা বোঝা সামলাক, তারা কেবল চেক লিখে দিয়েই খালাস।’
সিরিয়ার বিপর্যয়ের দায় এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রেরই বেশি। অথচ তাদের ‘রাইট টু প্রটেক্ট’ কিংবা ‘মানবিক হস্তক্ষেপের’ হাত সিরিয়ায় পৌঁছায় না। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কিছু সদস্যের ভাষ্য, শরণার্থীরা সন্ত্রাসীদের পাইপলাইন বানাবে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই সেক্যুলার সিরিয়ায় গণতন্ত্র রপ্তানির নামে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিয়েছে জঙ্গিদের। হাজার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ খেতাব দিয়ে সন্ত্রাসের পাইপলাইন এখনো চালু রেখেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের আট লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার অঙ্গীকার মহৎ দৃষ্টান্ত। জার্মানির এই উদারতার পেছনে রয়েছে অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। তাদের জনসংখ্যা কমতির দিকে। উন্নতি বজায় রাখতে আরও শ্রমিক চাই। প্রচলিত কোটায় এত শ্রমিক আনা সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, প্রধান দুই দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ও গ্রিন পার্টি একজোট হওয়ায় বর্ণবাদীদের আপত্তি ধোপে টিকছে না।
এই যুদ্ধের আগে সিরীয়রা কখনোই শরণার্থী হয়নি। পড়তে আসা সিরীয়রা আশ্রয়প্রার্থী হয়নি পাশ্চাত্যে। সেই সিরিয়ার এমন অবমাননায় আরবশাহির হাত থাকা লজ্জাজনক।

ইউরোপের শরণার্থী-সংকট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় শরণার্থী-সংকটে পড়েছে ইউরোপ—পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে এমন তথ্য প্রচারে মনে হচ্ছে ইউরোপের সমস্যাই যেন মূল মাথাব্যথার বিষয়। কিন্তু বিশ্ববাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত ভূমধ্যসাগরের অপর পারের আরব দেশগুলো, বিশেষত সিরিয়া ও ইরাকের বাস্তব পরিস্থিতির দিকে, যেখান থেকে লাখে লাখে মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি, সহায়সম্বল ছেড়ে প্রাণ হাতে করে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা উচিত, কেন তাদের ঘর ছাড়তে হচ্ছে? যে পরিস্থিতির কারণে তারা আপন মাতৃভূমি ত্যাগ করে বিপৎসংকুল পথে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরোতে বাধ্য হচ্ছে, অনেকে প্রাণ হারাচ্ছে, কী করে সৃষ্টি হলো সেই পরিস্থিতি? এই গুরুতর মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য দায়ী কারা?
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কোনোটা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে, কোনোটা চাপে পড়ে শরণার্থীদের গ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ঘোরতর আপত্তি তুলেছে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবশ্যই সম্মিলিতভাবে শরণার্থীদের আশ্রয়দানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা, এই শরণার্থী-সংকট সৃষ্টির পেছনে ইউরোপের দায় বিরাট। সবচেয়ে বড় দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। প্রথমে ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে এবং পরে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের অস্ত্রসহ সব ধরনের মদদ জোগানোর নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থেকেছে তার ইউরোপীয় মিত্রদেশগুলো।
প্রধানত মুসলমান এই শরণার্থীদের ব্যাপারে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর দৃশ্যমান অসংবেদনশীলতা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাদেরই প্রথমে এগিয়ে আসা উচিত ছিল, কারণ তারা উদ্বাস্তু সিরীয় ও ইরাকিদের নিকটতম প্রতিবেশী, তাদের জায়গা প্রচুর এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্যও যথেষ্ট রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের শরণার্থীদের সম্মানের সঙ্গে আশ্রয় দেওয়া ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব অবশ্যই পালন করতে হবে। কিন্তু তাতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধানের জন্য হাত দিতে হবে সমস্যার মূলে: সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের রাজনৈতিক সমাধান ও ইরাকসহ অন্যত্র ইসলামিক স্টেটকে সম্মিলিতভাবে পর্যুদস্ত করার মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্রীড়নকদের অশান্তির ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।