দক্ষিণ কলকাতার কসবা অঞ্চলের একটা বারোয়ারী দূর্গাপূজোতে এবছরের ‘থিম’ বা বিষয়ভাবনা ছিটমহল আর সেখানকার মানুষ, প্রায় সাত দশক ধরে নাগরিকত্ব হীন হয়ে বেঁচে থাকার কাহিনী।
কলকাতায় গড়ে ওঠা ছিটমহলে যেমন রয়েছে বি এস এফ আর বিজিবি-র পাহারা চৌকি, তেমনই আছে কাঁটাতারের বেড়া। পোয়াতুরকুঠি, মশালডাঙ্গা, শিবপ্রসাদ মুস্তাফি ছিটমহলগুলোর বাড়ি, মাজার, প্রাচীন শিবমন্দির আর দূর্গাপূজোর মণ্ডপ, পুকুর, চাষের ক্ষেত – চায়ের দোকান, স্কুল সবই তৈরী হয়েছে কসবা শক্তি সংঘের মাঠে।আবার রয়েছেন কয়েকজন সদ্য ভারতীয় হওয়া ছিটমহলের বাসিন্দারাও – কিছু মাটির মূর্তিতে আর কয়েকজন সশরীরে।
পূজো দেখতে আসা কলকাতার মানুষদের নিজেদের গ্রাম চিনিয়ে দিচ্ছিলেন বিলুপ্ত হওয়া ছিটমহল মশালডাঙ্গার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন, সাদ্দাম মিঞাঁ, শিবপ্রসাদ মুস্তাফি ছিটের বিষ্ণু বর্মন, পোয়াতুরকুঠির রহমান আলি বা ৭৫ বছর বয়সী মনসুর মিঞাঁরা।
জানাচ্ছেন কীভাবে পরিচয় হীন হয়ে বেঁচে থেকেছেন তাঁরা, কয়েকজন বয়স্ক তো আবার জীবনে দু দুটো স্বাধীনতা দেখলেও নিজেরা এতবছর পরাধীন হয়েই বেঁচে থেকেছেন।
এঁদের অনেকের এটাই প্রথম কলকাতায় আসা, আবার কয়েকজন আগে এলেও সেবারে সব সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়েছে – যদি বাংলাদেশী ছিটের বাসিন্দা বলে পুলিশ গ্রেপ্তার করে! স্বাধীনতা পাওয়ার পরে এখন তাঁরা নির্ভয়ে ঘুরতে পারছেন কলকাতায়।
কলকাতার মানুষ যে শুধু বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ছিটমহলগুলোর মানুষদের কথা শুনছেন, তা নয়, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন সেখানকার মানুষদের মাটির প্রতিমূর্তিও – যেগুলো ছড়ানো রয়েছে চায়ের দোকান বা মাজার বা নারকোল গাছে। দর্শকরা আরও দেখতে পাচ্ছেন ছয় বছরের জিহাদ হোসেন ওবামাকেও – ছিটমহলের প্রথম শিশু, যে নিজের বাবা-মায়ের আসল পরিচয় দিয়েই জন্ম নিয়েছিল ভারতের হাসপাতালে।
তার আগে সবাইকেই লুকিয়ে চুরিয়ে ভারতীয় পরিষেবা নিতে হলে বদলে ফেলতে হত বাবা-মা, বা স্বামী-স্ত্রীর নাম, পরিচয়। জিহাদ তার বাবা শাহজাহান শেখ আর মা আসমা বিবির সঙ্গে কলকাতায় এসেছে।
ছিটমহলের পূজো দেখতে আসা কয়েকজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম এখানে আসার আগে তাঁরা কতটা জানতেন ছিটমহলের সমস্যা বা সেগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিময়ের দাবীর ব্যাপারে।
দেখা গেল কয়েকজন ছিটমহলের ব্যাপারে কিছু খবর রাখেন, কিন্তু বেশীরভাগই জানতেন না ছিটমহল বিষয়টা কি। তবে এই দূর্গাপূজোয় ছিটের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে বা তাঁদের জীবনযাত্রা চোখে দেখে আন্দাজ পেয়েছেন কিছুটা।
এটাই উদ্দেশ্য ছিল ছিটমহলকে নিজেদের পূজোর ‘থিম’ হিসাবে তৈরী করতে, বলছিলেন পূজোর উদ্যোক্তা রক্তিম দাশ বা সনৎ মুখার্জীরা।
সেই উদ্দেশ্য কতটা সফল হল, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে এটা ঘটনা, প্রচার মাধ্যমের দৌলতে কলকাতার এই ছিটমহলের কথা বহু মানুষের কানে পৌঁছিয়েছে, আর সেকারণেই বোধহয় পূজো দেখতে ভীড় করছেন হাজার হাজার মানুষ।
সন্ধেবেলায় রীতিমতো লম্বা লাইন দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে কলকাতার ছিটমহলে।
ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে ১৬২ টি ছিটমহল বিনিময় শেষ হয়েছে কয়েকমাস আগেই। শেষ হয়েছে মানুষের নাগরিকত্ব হীনতার কঠিন লড়াই। কিন্তু আবারও ছিটমহল তৈরী হয়েছে - এবার খাস কলকাতা শহরে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন