চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আল বদর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও একাত্তরের ‘চট্টগ্রামের ত্রাস’ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
যুদ্ধকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলে নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতার জন্য ‘সাকা কোনো উদারতা পাওয়ার যোগ্য নয়’ বলে মন্তব্য করেছিল উচ্চ আদালত। আগামী মার্চে এই যুদ্ধাপরাধীর বয়স ৬৭ বছর হবে।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা ৬৮ বছর বয়সী মুজাহিদ সম্পর্কে আপিল বিভাগ বলেছিল, এ ধরনের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ পাওয়ার পর অপরাধী সর্বোচ্চ দণ্ড না পেলে তা হবে ন্যায়বিচারের পরিহাস।
একাত্তরে নির্বিচারে অসংখ্য মানুষের প্রাণ সংহার করলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মরিয়া হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছেন দুই যুদ্ধাপরাধী। সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর রোববার প্রথম প্রহরে তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়।
পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে দুজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।”
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর হলো।
সাকা, মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন গত বুধবার সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হয়; পরদিন রায় যায় কারাগারে। এরপর ফাঁসিকাষ্ঠ এড়াতে তাদের সামনে খোলা ছিল শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া।
তারা যে সেই আবেদন করেছেন তা শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান।
তবে পরিবারের সদস্যরা এরপরও ক্ষমা প্রার্থনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। দুই পরিবারের পক্ষ থেকেই বলা হয়, বন্দিদের সঙ্গে কথা বলার আগে তারা বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদেরের পরিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিচারকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে। এর প্রতিবিধান চেয়ে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন নিয়ে গেলেও তা গ্রহণ করা হয়নি।
অন্যদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের পরিবার ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার বিচারের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত রাখার আবেদন জানায়।
বিচারের সব প্রক্রিয়া শেষে এমন আবেদন ‘অযৌক্তিক’ বলে উড়িয়ে দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
যুদ্ধাপরাধী সাবেক এই দুই মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করার পর বিকাল থেকে কারাগার এলাকার নিরাপত্তা কয়েক গুণ বাড়ানো হয়।
রাত ৮টার কিছুক্ষণ আগে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল ফজলুল কবির ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢোকার পরই তৎপরতা বেড়ে যায়।
এরপর কারা কর্তৃপক্ষ সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের পরিবারকে দেখা করতে ডেকে পাঠালে কারা অভ্যন্তরের দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
কারাগারের ভেতরে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জ্বলে উঠে, কারারক্ষীদের ছোটাছুটিও ছিল লক্ষ্যণীয়।
কারাগারসহ আশেপাশের এলাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যে নেওয়া হয়। কারাগারের সামনের সড়কে যানচলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন কারাগারের আশেপাশের উঁচু ভবনে। বিভিন্ন বাহিনীর পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের সদস্য এবং সংবাদকর্মী ছাড়া কারাগারের আশেপাশে আর কাউকে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি সে সময়।
এর মাঝেই রাত ১০টার দিকে খবর আসে, রাষ্ট্রপতি দুই যুদ্ধাপরাধীর ক্ষমার আবেদন নাকচ করেছেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে কারাগারের ভেতরে যান।
মধ্যরাতে নিয়ম অনুযায়ী সাকা ও মুজাহিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। মৌলভী এসে ইসলামী রীতি অনুযায়ী আসামিদের তওবা পড়ান।
এরপর ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জামায়াতের এই সেক্রেটারি জেনারেলকে।
একাত্তরে বাংলাদেশের পতাকার বিরোধিতা করলেও তারা দুইজনই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে পতাকা নিয়ে ঘুরেছিলেন একসময়। এর মধ্যে মুজাহিদ ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সমাজকল্যাণমন্ত্রী হন।
অন্যদিকে এরশাদের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন সাকা চৌধুরী।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তিনি আপিল করলে চলতি বছরের ১৬ জুন চূড়ান্ত রায়েও ওই সাজা বহাল থাকে।
আর একাত্তরে চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদেরের রায় এসেছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় এ বছর ২৯ জুলাই আপিলের রায়েও বহাল থাকে।
তাদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় একই দিনে, ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দুজনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং কারা কর্তৃপক্ষ ১ অক্টোবর তা দুই ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনায়।
এরপর দুই যুদ্ধাপরাধী ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। শুনানি শেষে গত বুধবার আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও আপিল বেঞ্চের অন্য তিন বিচারকের দেওয়া দুই রায়েই বলা হয়, আপিল শুনানির পর দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি বিচারকদের নজরে আসেনি। সুতরাং দণ্ড পুনর্বিবেচনার কোনো কারণও তারা খুঁজে পাননি।
এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের এ দুই মামলার সব আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়।
শনিবার সাকা ও মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো ওই আবেদনে আইন মন্ত্রণালয় মতামত দেওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি রাতে দুই আবেদনই নাকচ করে দেন।
এর আগে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে, নৃশংসতার জন্য আলবদর বাহিনীর এই সদস্যের কুখ্যাতি ছিল মিরপুরের কসাই নামে।
এরপর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের অপর সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে; একাত্তরে তার নৃশংসতাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের নাৎসি বাহিনীর পাশবিকতার সঙ্গে তুলনা করে আদালত।
এই দুই যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর চিকন আলী নামে এক দালালের ফাঁসির রায় হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে, তবে জেনারেল জিয়ার আমলে তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে যান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঘাতক দালালদের বিচারে আইন প্রণয়ন করে আদালত গঠন করা হলেও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই উদ্যোগ থেমে যায়।
এরপর ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে দেশে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়, যা পরে রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে পরিণত হয়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এর আহ্বায়ক।
এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’ এর মাধ্যমে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের ‘নরঘাতক’ গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার শুরু করে। এই গোলাম আযমই ৯০ বছরের দণ্ড নিয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী নেই’ মন্তব্য করে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ সমালোচনার ঝড় তোলেন।
এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের উদ্যোগে গঠিত হয় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে তাদের আন্দোলনে শরিক হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি আওয়ামী লীগের ইশতেহারে স্থান পায়।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারে তরুণ প্রজন্ম ব্যাপক সাড়া দেয়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহুল প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়।
ওইদিন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। পরে আরো একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ বছর সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা ৬৮ বছর বয়সী মুজাহিদ সম্পর্কে আপিল বিভাগ বলেছিল, এ ধরনের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ পাওয়ার পর অপরাধী সর্বোচ্চ দণ্ড না পেলে তা হবে ন্যায়বিচারের পরিহাস।
একাত্তরে নির্বিচারে অসংখ্য মানুষের প্রাণ সংহার করলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মরিয়া হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছেন দুই যুদ্ধাপরাধী। সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর রোববার প্রথম প্রহরে তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়।
পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে দুজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।”
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর হলো।
সাকা, মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন গত বুধবার সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হয়; পরদিন রায় যায় কারাগারে। এরপর ফাঁসিকাষ্ঠ এড়াতে তাদের সামনে খোলা ছিল শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া।
তারা যে সেই আবেদন করেছেন তা শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান।
তবে পরিবারের সদস্যরা এরপরও ক্ষমা প্রার্থনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। দুই পরিবারের পক্ষ থেকেই বলা হয়, বন্দিদের সঙ্গে কথা বলার আগে তারা বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদেরের পরিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিচারকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে। এর প্রতিবিধান চেয়ে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন নিয়ে গেলেও তা গ্রহণ করা হয়নি।
অন্যদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের পরিবার ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার বিচারের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত রাখার আবেদন জানায়।
বিচারের সব প্রক্রিয়া শেষে এমন আবেদন ‘অযৌক্তিক’ বলে উড়িয়ে দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
যুদ্ধাপরাধী সাবেক এই দুই মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করার পর বিকাল থেকে কারাগার এলাকার নিরাপত্তা কয়েক গুণ বাড়ানো হয়।
রাত ৮টার কিছুক্ষণ আগে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল ফজলুল কবির ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢোকার পরই তৎপরতা বেড়ে যায়।
এরপর কারা কর্তৃপক্ষ সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের পরিবারকে দেখা করতে ডেকে পাঠালে কারা অভ্যন্তরের দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
কারাগারের ভেতরে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জ্বলে উঠে, কারারক্ষীদের ছোটাছুটিও ছিল লক্ষ্যণীয়।
কারাগারসহ আশেপাশের এলাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যে নেওয়া হয়। কারাগারের সামনের সড়কে যানচলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন কারাগারের আশেপাশের উঁচু ভবনে। বিভিন্ন বাহিনীর পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের সদস্য এবং সংবাদকর্মী ছাড়া কারাগারের আশেপাশে আর কাউকে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি সে সময়।
এর মাঝেই রাত ১০টার দিকে খবর আসে, রাষ্ট্রপতি দুই যুদ্ধাপরাধীর ক্ষমার আবেদন নাকচ করেছেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে কারাগারের ভেতরে যান।
মধ্যরাতে নিয়ম অনুযায়ী সাকা ও মুজাহিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। মৌলভী এসে ইসলামী রীতি অনুযায়ী আসামিদের তওবা পড়ান।
এরপর ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জামায়াতের এই সেক্রেটারি জেনারেলকে।
একাত্তরে বাংলাদেশের পতাকার বিরোধিতা করলেও তারা দুইজনই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে পতাকা নিয়ে ঘুরেছিলেন একসময়। এর মধ্যে মুজাহিদ ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সমাজকল্যাণমন্ত্রী হন।
অন্যদিকে এরশাদের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন সাকা চৌধুরী।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তিনি আপিল করলে চলতি বছরের ১৬ জুন চূড়ান্ত রায়েও ওই সাজা বহাল থাকে।
আর একাত্তরে চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদেরের রায় এসেছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় এ বছর ২৯ জুলাই আপিলের রায়েও বহাল থাকে।
তাদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় একই দিনে, ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দুজনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং কারা কর্তৃপক্ষ ১ অক্টোবর তা দুই ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনায়।
এরপর দুই যুদ্ধাপরাধী ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। শুনানি শেষে গত বুধবার আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও আপিল বেঞ্চের অন্য তিন বিচারকের দেওয়া দুই রায়েই বলা হয়, আপিল শুনানির পর দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি বিচারকদের নজরে আসেনি। সুতরাং দণ্ড পুনর্বিবেচনার কোনো কারণও তারা খুঁজে পাননি।
এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের এ দুই মামলার সব আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়।
শনিবার সাকা ও মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো ওই আবেদনে আইন মন্ত্রণালয় মতামত দেওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি রাতে দুই আবেদনই নাকচ করে দেন।
এর আগে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে, নৃশংসতার জন্য আলবদর বাহিনীর এই সদস্যের কুখ্যাতি ছিল মিরপুরের কসাই নামে।
এরপর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের অপর সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে; একাত্তরে তার নৃশংসতাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের নাৎসি বাহিনীর পাশবিকতার সঙ্গে তুলনা করে আদালত।
এই দুই যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর চিকন আলী নামে এক দালালের ফাঁসির রায় হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে, তবে জেনারেল জিয়ার আমলে তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে যান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঘাতক দালালদের বিচারে আইন প্রণয়ন করে আদালত গঠন করা হলেও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই উদ্যোগ থেমে যায়।
এরপর ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে দেশে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়, যা পরে রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে পরিণত হয়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এর আহ্বায়ক।
এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’ এর মাধ্যমে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের ‘নরঘাতক’ গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার শুরু করে। এই গোলাম আযমই ৯০ বছরের দণ্ড নিয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী নেই’ মন্তব্য করে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ সমালোচনার ঝড় তোলেন।
এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের উদ্যোগে গঠিত হয় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে তাদের আন্দোলনে শরিক হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি আওয়ামী লীগের ইশতেহারে স্থান পায়।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারে তরুণ প্রজন্ম ব্যাপক সাড়া দেয়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহুল প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়।
ওইদিন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। পরে আরো একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ বছর সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন