অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও গাড়ির কাগজপত্র না থাকার অভিযোগে মিরপুর সিএনজি লেগুনা ও বাসকে জরিমানা করায় ঐ রুটসহ বেশ কয়েকটি রুটে চলাচলরত সব গণপরিবহন বন্ধ করে দেয় শ্রমিকরা। শ্রমিকদের আকস্মিক অবরোধে বিপাকে পড়ে হাজারো যাত্রী। গতকাল রোববার তোলা ছবি -সংগ্রাম
কোনো প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আচমকা এক তরফাভাবে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয় মালিক-শ্রমিক পক্ষ। যাত্রী সাধারণকে পণবন্দী করে মওকা তুলে নেয়ার ঐতিহ্যগত কসরত মালিক-শ্রমিক পক্ষ একদমও ভুলে যায়নি। গতকাল রোববার সেই কসরতের মহড়ায় নগরজুড়ে পরিবহনের যে সঙ্কট শুরু হয়, তা দিনভর ভুগিয়ে তোলে রাজধানীবাসীকে। কয়েক ঘণ্টার খামখেয়ালীপনা শেষে কোনো কোনো রুটে হাতেগোনা কিছু পরিবহন চলতে শুরু করলেও ভোগান্তির মাত্রা বিন্দু পরিমাণও কমেনি। প্রয়োজনের তাগিদে যাদেরকে ঘরের বাইরে বের হতে হয়েছে, তাদেরকে পদে পদে ভোগান্তি নিয়েই গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে। কাজ শেষে ঘরে ফিরতেও সে সব ভোগান্তি লেগেই ছিল। গতকাল রোববার সপ্তাহের কর্মদিবসের শুরুতেই এমন দূরাবস্থার সৃষ্টি করে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাজপথজুড়ে জনগণের ভোগান্তি লেগেই ছিল।
ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও নকল লাইসেন্সের বিরুদ্ধে অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বাস চালককে কারাদ- দেয়ার প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিকরা প্রথম দিকে কয়েকটি রুটে বাস চলাচল বন্ধ রাখে। গতকাল রোববার সকাল ১০টা থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে এই অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এ অভিযানেই মিরপুরের তালতলা এলাকায় হিমাচল পরিবহনের এক বাসচালককে এক মাসের কারাদ- ও জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই ঘটনার পরপরই পরিবহন সংশ্লিষ্ট লোকজন ওই এলাকায় জড়ো হতে থাকে এবং পরে সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। ফলে সড়ক বন্ধ থাকায় ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা লোকজনকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে কয়েকটি বাসের চালককে জরিমানা ও সাজা দেয়ার প্রতিবাদে গতকাল সকালে শুরু করা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। বিকাল পাঁচটার পর অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।
তবে অবরোধ প্রত্যাহার হলেও সড়কে গাড়ির সংখ্যা কম। সন্ধ্যার পরও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শত শত যাত্রীকে গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। ফলে ভোগান্তি প্রলম্বিত হয়েছে রাতে।
গতকাল সকালে মিরপুরের তালতলায় বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত এক চালককে এক মাসের জেল দেয়। একে কেন্দ্র করে চালকরা রাজধানীতে বাস বন্ধ করে দেন এবং বেশ কিছু শ্রমিক মিরপুর-১০ নম্বর, পূরবীতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
হঠাৎ গণপরিবহন বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ে মিরপুর-আজিমপুর, গুলিস্তান-মতিঝিল, গাবতলী-উত্তরা-আজিমপুর, গাবতলী-গুলশান-বাড্ডা রুটসহ মিরপুর ১১ নম্বর হয়ে চলাচলরত বিভিন্ন রুটের যাত্রীদের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় তালতলার কাছে বিআরটিএর একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত এক গাড়িচালককে এক মাসের সাজা দেন। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন রুটের চালকরা ডিপোতে তাদের বাস ফিরিয়ে নিয়ে যান। পরে বেশ কিছু শ্রমিক মিরপুর-১০ নম্বর ও পূরবীতে অবস্থান নেন।
বিকালে বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব বলেন, “সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও বিআরটিএর চেয়ারম্যানের আশ্বাসে চালক ও শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহর করে নিয়েছে। আমাদের দাবি ছিল, যখন-তখন জেল না দিয়ে অন্য কোনো ব্যবস্থা যাতে চালকদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়।”
তবে অবরোধ প্রত্যাহার করা হলেও পর্যাপ্ত গাড়ি রাস্তায় নামেনি। ফলে মিরপুর, গুলিস্তান, শাহবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেট এলাকায় অফিসফেরত বহু যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। পরিবহন সংকটের কারণে ভোগান্তিতে পড়ে রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন পথের যাত্রীরা।
সকালের ঘটনার পর সারা দিনই পরিবহন সংকটের ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। বিকালে ভোগান্তি আরও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন বাস স্টপেজে অফিসফেরত যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। ফার্মগেট, গুলিস্তান, মিরপুর ১০ নম্বরে হাজার হাজার যাত্রীর সমাগম ঘটে। কিন্তু গণপরিবহন নেই। কোথাও বিআরটিসির কোনো বাস এলে তাতে যাত্রীদের হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেছে। সন্ধ্যা নেমে এলে বহু যাত্রীকে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দিতে দেখা গেছে। ফলে ফুটপাতে মানুষের মিছিল নামে।
অবরোধের কারণে স্টেডিয়াম ও এশিয়া সিনেমা হলের সামনে রাস্তার পাশে আলিফ পরিবহন, আকিক পরিবহন ও রবরব পরিবহনের শতাধিক বাস থামিয়ে রাখা ছিল।
বেলা ১১টার পর থেকে গুলিস্তান থেকে ঢাকার ভেতরে এবং আশপাশের জেলাগুলোতে কোনো বাস চলেনি। ফলে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলিস্তানে অপেক্ষা করতে হয়।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমের প্রতিবাদে গণপরিবহনের এ ধরনের ধর্মঘটকে মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্যের প্রমাণ বলে আখ্যায়িত করেছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধরী। নৈরাজ্য থামাতে নিয়মিত এ ধরনের কার্যক্রম চালান প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। “আইন সব সময় চালু রাখা গেলে আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। ভ্রাম্যমাণ আদালত সব সময় চালু রাখতে হবে। আইন কখনো শিথিল, কখনও প্রয়োগ করা হলে এ রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়।”
বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “অতীতেও দেখা গেছে সরকার ও মালিকপক্ষ মিলে সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে যাত্রীরা ভুক্তভোগী হয়েছে। এবারও তাই হয়েছে। এমনিতে যে ভাড়া ছিল তাও বেশি ছিল। এর মধ্যে নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধি জনজীবনে দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে।” বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারেরও দাবি জানান মোজাম্মেল হক।
বিকেল ৫টার দিকে জানান, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় স্বল্প পরিসরে দুয়েকটি বাস ও লেগুনা চলাচল করতে দেখা গেছে। বাসের অভাবে সেখানে ফুট ওভারব্রিজের ওপর এবং আশেপাশে অন্তত কয়েক হাজার মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।
একই চিত্র দেখা গেছে গুলিস্তান, শাহবাগ, বাংলামটর, ফার্মগেইট এলাকায়ও। বাসের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথের যাত্রীদের।
গুলিস্তানে বাসের জন্য অপেক্ষারত নারায়ণগঞ্জের খলিকুর রহমান জানান, তিনি দুই ঘণ্টা ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তবে কোনো বাস না থাকায় কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
মুন্সিগঞ্জে যাওয়ার বাস না পেয়ে দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন সখিনা বেগম। তিনি বলেন, “বেশ কয়েক ঘণ্টা বসে আছি, গাড়ি পাচ্ছি না। আদৌ পাব কীনা বুঝতে পারছি না।”
গুলিস্তানে বাস বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাওয়া হলে সিটি বন্ধন পরিবহনের টিকেট বিক্রেতা হেমায়েতুল্লাহ বলেন, “মালিকের নির্দেশে বাস বন্ধ আছে। ছাড়তে না বলা পর্যন্ত বাস চলবে না।” সকাল ১১টার পর থেকে গুলিস্তান থেকে ঢাকার ভেতরে এবং আশপাশের জেলাগুলোতে কোনো বাস চলেনি বলেও জানান তিনি।
গুলিস্তানে রাস্তার দুই পাশে কয়েক হাজার যাত্রীকে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছেন শহীদুল ইসলাম।
বিকেল ৪টার দিকেও বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল বন্ধ ছিল। তবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ‘যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে’। বেলা আড়াইটার দিকেও মিরপুর ১১ নম্বরে পূরবী সিনেমা হলের সামনে অবস্থান নেয়া শতাধিক শ্রমিককে বিভিন্ন ধরনের স্লোগানও দিতে দেখা গেছে।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে তাদের কয়েকজন চালককে জরিমানা ও সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ট্রাফিক পুলিশ ‘নানা অজুহাতে’ নিয়মিতই তাদের হয়রানি করেন বলে অভিযোগ করেন আশফাকুল নামে এক শ্রমিক। তিনি বলেন, “আমরা পেটের দায়ে কাজ করি। প্রতিদিনই নির্দিষ্ট হারে টাকা মালিকের হাতে দিতে হয়, দিতে না পারলে উল্টো আমাদের মজুরি কেটে রাখা হয়। এ অবস্থায় রাস্তায় গাড়ি নামালেই যদি জরিমানা গুণতে হয় তাহলে তো এই কাজ করে ভাত জোটানো সম্ভব না।”
এর আগে বেলা ২টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা একটি বিআরটিসি বাসসহ কয়েকটি গণপরিবহনের কাচ ভেঙে দেয়।
পূরবী সিনেমা হলের সামনে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত কয়েকজন যাত্রী জানান, উত্তরা থেকে এসে অনেকেই সেখানে আটকে গেছেন। শ্রমিকরা যাত্রীদের নামিয়ে বাস ঘুরিয়ে দিচ্ছে। প্রায় একই ভাষ্য মিলল গাবতলী থেকে রবরব নামে একটি বাসে করে আসা যাত্রীদের কাছেও।
রাজিউন ইসলাম নামে একজন ব্যবসায়ী জানান, তিনি তার দোকানের মালপত্র নিয়ে গুলশান যাচ্ছিলেন। পূরবী আসার পর শ্রমিকরা তাদের জোর করে নামিয়ে দিয়েছে।
বাস বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়া অনেক যাত্রীকেই পায়ে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, “প্রতিবার বাস ভাড়া বাড়ানোর পর কিছুটা নিয়ম-অনিয়ম হয়। এবার বাস ভাড়া বৃদ্ধির পর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট চলন্ত বাস থেকে চালক ও শ্রমিকদের নামিয়ে কারাদ- দিয়ে দেন। “শ্রমিকরা আগে থেকেই আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসছিল। আজও এরকম একটি ঘটনার পর চালক ও শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দেয়।” শ্রমিকদের সঙ্গে বসে অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে এম আল আমিন বলেন, তিনি নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে সাড়ে নয়টায় মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন সকাল ১০টার পরে কিছুক্ষণের জন্য রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি দাবি করেন, এর সঙ্গে মোবাইল কোর্টের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না তা তিনি জানেন না। তিনি জানান, আজ হিমাচল পরিবহনসহ আরও কয়েকটি পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায়, ভাড়ার তালিকা না থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিভিন্ন পরিবহনের বিরুদ্ধে ১৫ টি মামলা করা হয়েছে ও ১৩ হাজার ৪০০ জরিমানা করা হয়েছে। এ সময় দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও একটি লেগুনা জব্দ করা হয়েছে। হিমাচল পরিবহনের চালকের সহকারীকে এক মাসের কারাদ- দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আগে এর চেয়েও বেশি জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো হট্টগোল হয়নি।
daily sangram
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে কয়েকটি বাসের চালককে জরিমানা ও সাজা দেয়ার প্রতিবাদে গতকাল সকালে শুরু করা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। বিকাল পাঁচটার পর অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।
তবে অবরোধ প্রত্যাহার হলেও সড়কে গাড়ির সংখ্যা কম। সন্ধ্যার পরও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শত শত যাত্রীকে গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। ফলে ভোগান্তি প্রলম্বিত হয়েছে রাতে।
গতকাল সকালে মিরপুরের তালতলায় বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত এক চালককে এক মাসের জেল দেয়। একে কেন্দ্র করে চালকরা রাজধানীতে বাস বন্ধ করে দেন এবং বেশ কিছু শ্রমিক মিরপুর-১০ নম্বর, পূরবীতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
হঠাৎ গণপরিবহন বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ে মিরপুর-আজিমপুর, গুলিস্তান-মতিঝিল, গাবতলী-উত্তরা-আজিমপুর, গাবতলী-গুলশান-বাড্ডা রুটসহ মিরপুর ১১ নম্বর হয়ে চলাচলরত বিভিন্ন রুটের যাত্রীদের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় তালতলার কাছে বিআরটিএর একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত এক গাড়িচালককে এক মাসের সাজা দেন। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন রুটের চালকরা ডিপোতে তাদের বাস ফিরিয়ে নিয়ে যান। পরে বেশ কিছু শ্রমিক মিরপুর-১০ নম্বর ও পূরবীতে অবস্থান নেন।
বিকালে বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব বলেন, “সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও বিআরটিএর চেয়ারম্যানের আশ্বাসে চালক ও শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহর করে নিয়েছে। আমাদের দাবি ছিল, যখন-তখন জেল না দিয়ে অন্য কোনো ব্যবস্থা যাতে চালকদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়।”
তবে অবরোধ প্রত্যাহার করা হলেও পর্যাপ্ত গাড়ি রাস্তায় নামেনি। ফলে মিরপুর, গুলিস্তান, শাহবাগ, বাংলামোটর, ফার্মগেট এলাকায় অফিসফেরত বহু যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। পরিবহন সংকটের কারণে ভোগান্তিতে পড়ে রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন পথের যাত্রীরা।
সকালের ঘটনার পর সারা দিনই পরিবহন সংকটের ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। বিকালে ভোগান্তি আরও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন বাস স্টপেজে অফিসফেরত যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। ফার্মগেট, গুলিস্তান, মিরপুর ১০ নম্বরে হাজার হাজার যাত্রীর সমাগম ঘটে। কিন্তু গণপরিবহন নেই। কোথাও বিআরটিসির কোনো বাস এলে তাতে যাত্রীদের হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেছে। সন্ধ্যা নেমে এলে বহু যাত্রীকে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দিতে দেখা গেছে। ফলে ফুটপাতে মানুষের মিছিল নামে।
অবরোধের কারণে স্টেডিয়াম ও এশিয়া সিনেমা হলের সামনে রাস্তার পাশে আলিফ পরিবহন, আকিক পরিবহন ও রবরব পরিবহনের শতাধিক বাস থামিয়ে রাখা ছিল।
বেলা ১১টার পর থেকে গুলিস্তান থেকে ঢাকার ভেতরে এবং আশপাশের জেলাগুলোতে কোনো বাস চলেনি। ফলে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলিস্তানে অপেক্ষা করতে হয়।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমের প্রতিবাদে গণপরিবহনের এ ধরনের ধর্মঘটকে মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্যের প্রমাণ বলে আখ্যায়িত করেছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধরী। নৈরাজ্য থামাতে নিয়মিত এ ধরনের কার্যক্রম চালান প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। “আইন সব সময় চালু রাখা গেলে আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। ভ্রাম্যমাণ আদালত সব সময় চালু রাখতে হবে। আইন কখনো শিথিল, কখনও প্রয়োগ করা হলে এ রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়।”
বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “অতীতেও দেখা গেছে সরকার ও মালিকপক্ষ মিলে সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে যাত্রীরা ভুক্তভোগী হয়েছে। এবারও তাই হয়েছে। এমনিতে যে ভাড়া ছিল তাও বেশি ছিল। এর মধ্যে নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধি জনজীবনে দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে।” বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারেরও দাবি জানান মোজাম্মেল হক।
বিকেল ৫টার দিকে জানান, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় স্বল্প পরিসরে দুয়েকটি বাস ও লেগুনা চলাচল করতে দেখা গেছে। বাসের অভাবে সেখানে ফুট ওভারব্রিজের ওপর এবং আশেপাশে অন্তত কয়েক হাজার মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।
একই চিত্র দেখা গেছে গুলিস্তান, শাহবাগ, বাংলামটর, ফার্মগেইট এলাকায়ও। বাসের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথের যাত্রীদের।
গুলিস্তানে বাসের জন্য অপেক্ষারত নারায়ণগঞ্জের খলিকুর রহমান জানান, তিনি দুই ঘণ্টা ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তবে কোনো বাস না থাকায় কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
মুন্সিগঞ্জে যাওয়ার বাস না পেয়ে দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন সখিনা বেগম। তিনি বলেন, “বেশ কয়েক ঘণ্টা বসে আছি, গাড়ি পাচ্ছি না। আদৌ পাব কীনা বুঝতে পারছি না।”
গুলিস্তানে বাস বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাওয়া হলে সিটি বন্ধন পরিবহনের টিকেট বিক্রেতা হেমায়েতুল্লাহ বলেন, “মালিকের নির্দেশে বাস বন্ধ আছে। ছাড়তে না বলা পর্যন্ত বাস চলবে না।” সকাল ১১টার পর থেকে গুলিস্তান থেকে ঢাকার ভেতরে এবং আশপাশের জেলাগুলোতে কোনো বাস চলেনি বলেও জানান তিনি।
গুলিস্তানে রাস্তার দুই পাশে কয়েক হাজার যাত্রীকে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছেন শহীদুল ইসলাম।
বিকেল ৪টার দিকেও বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল বন্ধ ছিল। তবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ‘যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে’। বেলা আড়াইটার দিকেও মিরপুর ১১ নম্বরে পূরবী সিনেমা হলের সামনে অবস্থান নেয়া শতাধিক শ্রমিককে বিভিন্ন ধরনের স্লোগানও দিতে দেখা গেছে।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে তাদের কয়েকজন চালককে জরিমানা ও সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ট্রাফিক পুলিশ ‘নানা অজুহাতে’ নিয়মিতই তাদের হয়রানি করেন বলে অভিযোগ করেন আশফাকুল নামে এক শ্রমিক। তিনি বলেন, “আমরা পেটের দায়ে কাজ করি। প্রতিদিনই নির্দিষ্ট হারে টাকা মালিকের হাতে দিতে হয়, দিতে না পারলে উল্টো আমাদের মজুরি কেটে রাখা হয়। এ অবস্থায় রাস্তায় গাড়ি নামালেই যদি জরিমানা গুণতে হয় তাহলে তো এই কাজ করে ভাত জোটানো সম্ভব না।”
এর আগে বেলা ২টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা একটি বিআরটিসি বাসসহ কয়েকটি গণপরিবহনের কাচ ভেঙে দেয়।
পূরবী সিনেমা হলের সামনে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত কয়েকজন যাত্রী জানান, উত্তরা থেকে এসে অনেকেই সেখানে আটকে গেছেন। শ্রমিকরা যাত্রীদের নামিয়ে বাস ঘুরিয়ে দিচ্ছে। প্রায় একই ভাষ্য মিলল গাবতলী থেকে রবরব নামে একটি বাসে করে আসা যাত্রীদের কাছেও।
রাজিউন ইসলাম নামে একজন ব্যবসায়ী জানান, তিনি তার দোকানের মালপত্র নিয়ে গুলশান যাচ্ছিলেন। পূরবী আসার পর শ্রমিকরা তাদের জোর করে নামিয়ে দিয়েছে।
বাস বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়া অনেক যাত্রীকেই পায়ে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, “প্রতিবার বাস ভাড়া বাড়ানোর পর কিছুটা নিয়ম-অনিয়ম হয়। এবার বাস ভাড়া বৃদ্ধির পর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট চলন্ত বাস থেকে চালক ও শ্রমিকদের নামিয়ে কারাদ- দিয়ে দেন। “শ্রমিকরা আগে থেকেই আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসছিল। আজও এরকম একটি ঘটনার পর চালক ও শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দেয়।” শ্রমিকদের সঙ্গে বসে অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে এম আল আমিন বলেন, তিনি নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে সাড়ে নয়টায় মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন সকাল ১০টার পরে কিছুক্ষণের জন্য রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি দাবি করেন, এর সঙ্গে মোবাইল কোর্টের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না তা তিনি জানেন না। তিনি জানান, আজ হিমাচল পরিবহনসহ আরও কয়েকটি পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায়, ভাড়ার তালিকা না থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিভিন্ন পরিবহনের বিরুদ্ধে ১৫ টি মামলা করা হয়েছে ও ১৩ হাজার ৪০০ জরিমানা করা হয়েছে। এ সময় দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও একটি লেগুনা জব্দ করা হয়েছে। হিমাচল পরিবহনের চালকের সহকারীকে এক মাসের কারাদ- দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আগে এর চেয়েও বেশি জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো হট্টগোল হয়নি।
daily sangram
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন