ভারতে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে টিম স্পিরিট এবং ঝুঁকি নেওয়ার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তাদের নানা ধরনের দু:সাহসিক খেলা বা 'অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে' অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব পার্সোনেল অ্যান্ড ট্রেনিং তাদের এক নির্দেশনামায় জানিয়েছে, সরকারি কর্মীরা যদি রক ক্লাইম্বিং, প্যারাগ্লাইডিং, বেলুনিং বা বিচ ট্রেকিংয়ের মতো নানা অ্যাডভেঞ্চারে অংশ নেন তাহলে সরকারই তার খরচ বহন করবে।তবে প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর কাজের ধারায় এটা কোনও পরিবর্তন আনতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ভারতে সরকারি কর্মচারীদের সম্পর্কে সাধারণভাবে যে ধারণাটা প্রচলিত তা হল এরা দ্রুত কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, দিনের পর দিন ফাইল আটকে বসে থাকেন এবং সরকারের কোনও বিভাগই কখনওই একটা ‘টিম’ বা দল হিসেবে কাজ করে না।
এখন কেন্দ্রীয় সরকার তার কর্মীদের হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিং কিংবা গোয়ার সৈকতে বিচ হাইকিং করতে পাঠিয়ে সেই ছবিটাই পাল্টাতে চাইছেন – কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা নিয়ে সাবেক শীর্ষ আমলারা অনেকেই সন্দিহান।
ভারতের সাবেক ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ও এ দেশের বাবুডম নিয়ে গবেষণাধর্মী বইয়ের লেখক টিএসআর সুব্রহ্মণ্যম যেমন বিবিসিকে বলছিলেন, ‘অ্যাডভেঞ্চারে ঝুঁকি নেওয়া আর সরকারি কাজে ঝুঁকি নেওয়ার মধ্যে কিন্তু অনেক ফারাক। ফলে একটা আর একটাকে ট্রিগার করবে কি না তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। তবে হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট কেনেডি সবাইকে দৌড়তে বলতেন, নিজেও শুরু করেছিলেন – সরকারি কর্মীদের শারীরিকভাবে ফিট থাকাটা নিশ্চয় জরুরি।’
সরকার বলছে, এই সব অ্যাক্টিভিটির জন্য তারা কর্মী-পিছু বছরে কুড়ি হাজার রুপি পর্যন্ত খরচ বহন করবে। ভারতে করদাতাদের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত মনিটর করে যে ইন্ডিয়া ট্যাক্সপেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন তারা অবশ্য এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
ওই সংস্থার প্রেসিডেন্ট শান্তাকুমার বলছিলেন এই ধরনের অ্যাক্টিভিটিতে কর্মীদের মধ্যে এক সঙ্গে কাজ করার মানসিকতা বাড়বে বলেই তার বিশ্বাস।
তার কথায়, ‘বস্তুত সরকারি কর্মীদের চাকরির মেয়াদের সময় তাদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ থাকলেও কখনও তা ঠিকঠাক খরচ হয় না। দেখা যায়, তারা ছোটখাটো ঝুঁকি নিতেও ভয় পান – আর তাতে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়।’
যদিও ঝুঁকি না-নেওয়াতে কোনও অন্যায় দেখেন না পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন – যিনি এই পুরো ভাবনাটা নিয়ে খুব একটা উৎসাহিত বোধ করছেন না।
অর্ধেন্দু সেন বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমার মনে হয় না ঝুঁকি নিতে আমলাদের উৎসাহিত করা উচিত। আমরা যে সিস্টেমে কাজ করি তাতে ঝুঁকি নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয় – এমন কী শাস্তি দেওয়া হয়। সরকার এখন বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে একসাথে কাজ করা শিখছে, আমার মনে হয় ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপারটা সেই প্রাইভেট পার্টনারদের ওপরই ছেড়ে দিলে ভাল!’
তবে মি সেন সেই সঙ্গেই মনে করেন টিম স্পিরিটকে অবশ্যই উৎসাহ দেওয়া দরকার – কিন্তু পনেরো দিনের একটা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট করে সেই স্পিরিট কতটা বিকশিত হবে তা বলা খুব মুশকিল। ‘তাহলে গত একশো-দুশো বছর আমরা এটা করিনি কেন?’, প্রশ্ন তুলছেন তিনি।
দিল্লিতে নানা সরকারি খাতে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন দেবাশিস ভট্টাচার্য, তারও এই পদক্ষেপ নিয়ে নানা সন্দেহ আছে।
মি ভট্টাচার্য মনে করেন, ‘মানুষ তখনই একটা টিমে কাজ করে যখন লক্ষ্যটা নির্দিষ্ট থাকে, প্রত্যেকের ভূমিকা ও দায়িত্ব ঠিক করে দেওয়া থাকে – এবং প্রত্যেকের জবাবদিহিতার দায় থাকে। একমাত্র তখনই মানুষ উপলব্ধি করে অন্যদের সাহায্য পেলে তবেই কাজটা আমি অনেক ভালভাবে করতে পারব।’
ভারতের বেসরকারি বা কর্পোরেট খাতে অবশ্য বহুদিন ধরেই কর্মীদের নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার অ্যাক্টিভিটি বা ডে-আউট করার রেওয়াজ চালু আছে।
কিন্তু সরকারের ভেতর একই ধরনের উদ্যোগ কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে নানা মহলেই এখনও প্রবল সন্দেহ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন