ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অন্তত ছয়টি স্থানে সন্ত্রাসী হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। একটি রেস্তোরাঁর পাশে পড়ে আছে ওই হামলায় নিহত কয়েকটি নিথর দেহ -রয়টার্স
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের অন্তত ছয়টি স্থানে সন্ত্রাসী হামলায় কমপক্ষে ১২৮ জন নিহত হয়েছেন। ভয়াবহ এসব হামলায় আরো দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশংকাজনক। স্থানীয় সময় গত শুক্রবার রাতে এসব সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এএফপি/এপি/বিবিসি/রয়টার্স/আলজাজিরা।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হামলাকারীরা রেস্তোরাঁ, পানশালা, একটি কনসার্ট হল ও একটি ফুটবল স্টেডিয়ামের বাইরে আক্রমণ চালায়।
এ হামলার পর দেশটির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ দেশে জরুরি অবস্থা এবং তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে দেশটির সকল সীমান্ত বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আর নাগরিকদের ঘরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম এ ধরনের ঘটনা ঘটলো। প্যারিসে কারফিউ জারি করা হয়েছে। প্যারিসের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেট্রো স্টেশনগুলো বন্ধ করা হয়েছে। সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ। জরুরিকালীন ভিত্তিতে চলছে কিছু রেল ও বিমান। এ ছাড়া ফরাসী পুলিশ আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্যারিস এলাকায় সব ধরনের জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
গতকাল শনিবার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি ১৫০০ সেনাও মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে ইসলামিক স্টেট গ্রুপ এ হামলার দায় স্বীকার করেছে।
এই হামলার ঘটনায় নগরীর কেন্দ্রস্থলে বাতাক্লঁ কনসার্ট হলেই অন্তত ১২০ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
কনসার্ট দেখতে ওই হলে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। এরই মধ্যে অন্তত তিন হামলাকারী হলে ঢুকে কালাশনিকভের মতো দেখতে রাইফেল নিয়ে নির্বিচারে গুলী চালাতে শুরু করে বলে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান। পরে হামলাকারীরা ওই হলে অনেককে পণবন্দী করলে পুলিশ ভারী অস্ত্রসহ সেখানে অভিযান চালায়। সংঘর্ষে অন্তত আটজন হামলাকারী নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
অন্য হামলাগুলো হয়েছে কয়েকটি বার ও রেস্তোরাঁয়। এর মধ্যে স্টেডিয়ামের কাছের ঘটনাটি আত্মঘাতী হামলা বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব হামলায় কম্বোডিয়ান একটি রেস্তোরাঁ, একটি পানশালার বাইরে, একটি অ্যাভিনিউতে এবং নগরের বাইরে এক স্থানে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই হামলার নিন্দা জানিয়ে হোতাদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানিয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফ্রান্সের পাশে থাকার কথা বলেছে ন্যাটো।
যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
প্যারিসে এই সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহতায় ক্ষুব্ধ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এক টুইটে বলেছেন সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা নিয়ে তারা ফ্রান্সের মানুষের পাশে থাকবেন।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, প্যারিসে এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তিনি বিস্মিত, হতবাক।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই হামলা ছিল সংঘবদ্ধ। তবে এই হামলা সংঘবদ্ধ এবং পরিকল্পিত কিনা, তা এখনি বলা সম্ভব নয় বলে প্যারিসের পুলিশ জানিয়েছে।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৮টা নাগাদ প্রথম হামলাটি হয় স্ট্যাডে ডি ফ্রান্স স্টেডিয়ামের বাইরে। সেখানে তখন ফ্রান্স-জার্মানি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ চলছিল। স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ। এর পরই একের পর এক হামলা শুরু হয় প্যারিসের বিভিন্ন প্রান্তে।
সব চেয়ে বড় হামলাটি হয়েছে বাতাক্লাঁ কনসার্ট হলে। জিহাদি স্লোগান তুলে ভিড়ে ঠাসা হলে ঢুকে পড়ে আত্মঘাতী জঙ্গি বাহিনী। সিরিয়ায় ফরাসী হানার বিরুদ্ধেও স্লোগান উঠতে থাকে। শুরুতেই শতাধিক দর্শককে পণবন্দী করে নেয় জঙ্গিরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পণবন্দীদের অনেককেই জঙ্গিরা একে একে গুলী করে মারছিল। এরপর সেনা অভিযান শুরু হতেই একের পর এক আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে জঙ্গিরা। কনসার্ট হলে হামলাতেই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
নিহতদের স্মরণে অন্ধকারে আইফেল টাওয়ার : প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের শোকে প্যারিসের প্রতীক আইফেল টাওয়ারের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ফ্রান্সের রাজধানী শহরে এই সন্ত্রাসী হামলায় ১২৮ জন নিহত হয়েছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে যেখানে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ছিল সেখানে এলইডি আলোয় ফ্রান্সের পতাকার রং নীল, সাদা ও লাল রঙ্গের রাঙিয়ে নিহতদের স্মরণ করছে।
আইএসের দায় স্বীকার
আরটিএনএন : ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করেছে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি গোয়েন্দা নজরদারি সংস্থা ‘সাইট’ তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানিয়েছে। সাইট বলছে, আরবি ও ফরাসী ভাষায় আইএস প্যারিসে হামলার দায় স্বীকার করে ভিডিও প্রকাশ করেছে।
হামলাকারী সবাই নিহত: পুলিশ প্রধান
এপি: প্যারিসে গুলী ও বোমা বর্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের সবাই নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফ্রান্স পুলিশ।
প্যারিসের পুলিশ প্রধান মাইকেল কাদোঁ বলেন, আক্রমণকারীদের সকলেই নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে পুলিশ এখনো সন্দেহভাজন হামলাকারীদের ধরার জন্য তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে।
প্যারিসের কনসার্ট হলে যে ৪ জন হামলা চালিয়ে ছিল তারা পুলিশের অভিযান শুরুর পর আত্মহত্যা করে। হামলাকারী ৩ জনের শরীরে বিস্ফোরক বেল্ট ছিল যা তাদের নিজেদের শরীরেই বিস্ফোরিত হয়। কনসার্ট হলের হামলায় কমপক্ষে ১০০ জন নিহত হয়েছে।
কনসার্ট স্থলে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, হামলাকারীদের একজনকে তিনি বলতে শুনেছেন সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করায় ফ্রান্সকে এই শাস্তি পেতে হলো।
পিয়েরে জানাসজ্যাক নামের ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি পরিষ্কার শুনেছি তারা বলছে, এটি তোমাদের প্রেসিডেন্টের ভুল, সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে সে ভুল করেছে। তারা ইরাকের কথাও বলেছে।’
তখন অনেক মানুষের চিৎকার শুনতে পাই: শিল্পী সাহাবুদ্দিন
বিবিসি: শুক্রবার রাতে প্যারিসের কয়েকস্থানে প্রায় একই সঙ্গে এসব হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলীর পাশাপাশি বোমার বিস্ফোরণও ঘটানো হয়।
বিবিসি বাংলার কাছে কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
প্যারিসে যেসব স্থানে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তারই একটির কাছে একটি কফির দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চিত্রশিল্পী সাহাবুদ্দিন।
তিনি বলছিলেন, শুক্রবার এ-রকম স্থানে অনেক মানুষের ভিড় থাকে। হঠাৎ করেই সেখানে পুলিশের আনাগোনা দেখতে পান। বাইরে গুলীর শব্দ শোনা যেতে থাকে আর পুলিশ এসে কফির দোকানের দরজা আটকে দেয়।
চিত্রশিল্পী সাহাবুদ্দিন বলছেন, গুলীর শব্দ শুনে ভয়ে আমরা পেছনের দরজা দিয়ে একটি বাগানে গাছের নিচে এক ঘণ্টার মতো লুকিয়ে ছিলাম।
পুলিশ বলেছে, তোমরা এখান থেকে নড় না, কারণ সন্ত্রাসীরা এখনো গুলী ছুঁড়ছে। সেখানে আমরা ৮০/৯০ জনের মতো লুকিয়ে ছিলাম।
কনসার্ট হলে জিম্মিদের উদ্ধারে পুলিশ হেলিকপ্টার নিয়ে অভিযান শুরু করে। তখন আমাদের বলা হয়, তোমরা এখনি ট্যাক্সি নিয়ে নিজেদের বাড়িতে চলে যাও। তিনি বলেন হামলার ঘটনায় শোকাহত হয়ে পড়েছে প্যারিস, মিজ সাহাবুদ্দিন বলছেন, এই প্রথম বারের মতো প্যারিসে আমরা এ ধরনের চিত্র দেখলাম যে, আমাদের মতো শত শত তরুণ বিভিন্ন গলিতে লুকিয়ে রয়েছে। তারা আস্তে আস্তে বেরিয়ে গাড়ি ধরার চেষ্টা করছে। মেট্টো বন্ধ করে দেখা হয়েছে, রাস্তা রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড।
চারদিকে শুধু পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স। গত শুক্রবার রাতে প্যারিস সরগরম থাকে। কিন্তু প্যারিসের আজকের (শনিবার) মতো এ-রকম চিত্র আমি আর কখনই দেখিনি, চারদিকেই নীরব, ভীতিকর একটি পরিবেশ।
প্যারিসের আরেকটি এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলামের বাসার ঠিক উল্টো দিকে একটি এলাকায় হামলা করে সন্ত্রাসীরা।
জানালা দিয়ে আমরা অনেক লোকজনকে ছোটাছুটি করতে দেখতে পাই। কিছু পরে আমাদের একজন গ্রাহক সেখানে গিয়ে দেখতে পান, দশ-বারো জন মানুষ মাটিতে পড়ে রয়েছে। লাভলু বড়ুয়া, প্যারিসের একজন বাসিন্দা, তিনি বলছেন, আমি ঘরে বসে ইন্টারনেটে কাজ করছিলাম। হঠাৎ প্রচুর মানুষের ছোটাছুটির শব্দ শুনতে পাই। হঠাৎ করে এ-রকম একটি পরিস্থিতি দেখে আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। তখন অনেক মানুষের চিৎকার শুনতে পাই।
রোডে দ্য শাও নামের সড়কের পাশে একটি রেস্তরাঁয় হামলা চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তার পাশেই একটি এশিয়ান রেস্তরাঁয় কাজ করেন বাংলাদেশে লাভলু বড়ুয়া।
তিনি বলছিলেন, আমাদের রেস্তরাঁর দুইশ গজ দূরেই, একটি ফরাসি রেস্তোরাঁ টেরাসে (খোলা জায়গায়) বসে খাবার ব্যবস্থা আছে। সন্ত্রাসীরা সেটা লক্ষ্য করেই হামলা করে। টেরাসে বসে যারা খাচ্ছিল, তাদেরকে লক্ষ্য করেই তারা গুলী করতে শুরু করে।
পুলিশকে সহায়তা করতে প্যারিসে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে গোলাগুলীর শব্দ শুনে প্রথমে তারা ভেবেছিলেন, সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন হওয়ায় হয় তো কেউ আতশবাজি ফোটাচ্ছে। একটু পরে দেখতে পেলেন, সব রেস্তরাঁর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, তাদের রেস্তরাঁর দরজাও বন্ধ করে দেয়া হয়।
লাভলু বড়ুয়া বলছিলেন, জানালা দিয়ে আমরা অনেক লোকজনকে ছোটাছুটি করতে দেখতে পাই। কিছু পরে আমাদের একজন গ্রাহক সেখানে গিয়ে দেখতে পান, দশ-বারোজন মানুষ মাটিতে পড়ে রয়েছে।
মেট্টো চলাচল বন্ধ আর রাস্তাগুলো পুলিশ আটকে দেয়ায় প্রায় ৪৫ মিনিট হেঁটে তিনি বাসায় ফেরেন।
প্যারিসে হামলা বিস্ময়কর ঘটনা
বিবিসি: হামলার আকার ধারণা করতে না পারলেও এ-ধরনের একটি হামলা বিশ্লেষকদের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল বলে মনে করেন না বিশ্লেষক আলী রিয়াজ।
বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিশয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী ইয়াজ বলেন, ফ্রান্সে এখন ইউরোপের সবচেয়ে বড় মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে এবং একই সঙ্গে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইহুদী জনগোষ্ঠীও ফ্রান্সে। গত কিছুদিন যাবৎ সেখানে আমরা এন্টি সেমিটিজম এবং ইসলামোফোবিয়া বাড়তে দেখেছি, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনীতিতে দক্ষিণ পন্থিদের উত্থান এবং শরণার্থী সংকট। এ-সব মিলিয়ে সেখানে একটি অস্থির মিশ্রণ তৈরি হয়েছে।
আলী রিয়াজ বলেন, হামলাটি যেভাবে হয়েছে তাতে এটি বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয় না এবং হামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতেই ওবামা এ মন্তব্য করে থাকতে পারেন।
এই হামলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স এখন আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে বলে ধারণা করছেন অধ্যাপক রিয়াজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন