ভারত ও নেপালের মধ্যে গত দেড় মাস ধরে যে শীতল উত্তেজনা চলছে, গতকাল দুদেশের সীমান্ত এলাকায় নেপালি পুলিশের গুলিতে এক ভারতীয় যুবকের মৃত্যুর পর সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাঠমান্ডুতে নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে এই মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র অসন্তোষ জানিয়েছেন।ওদিকে ভারত-সীমান্তে অঘোষিত অবরোধ চলতে থাকায় নেপাল এই প্রথম তাদের উত্তরের প্রতিবেশী চীনের কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি শুরু করেছে, যার প্রথম চালান মঙ্গলবারই এসে পৌঁছেছে।
কিন্তু নেপাল-ভারত সম্পর্কে আচমকা এত দ্রুত অবনতির কারণ কী?
মাত্র বছরখানেক আগেও কাঠমান্ডুর রাজপথে সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিবাদন জানাতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছিলেন। নেপালের পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়ে প্রতিবেশীদের মনও জয় করে নিয়েছিলেন মি মোদি।
কিন্তু ওই সফরের ঠিক তেরো মাসের মাথায় নেপাল তাদের নতুন সংবিধান অনুমোদন করে, আর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সে দেশের ভারত সীমান্তঘেঁষা এলাকার মদহেশিরা – যাদের পেছনে দিল্লিরও প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে বলে পর্যবেক্ষকরা একমত।
মদহেশি নেতা ও নেপাল সদ্ভাবনা পার্টির প্রধান রাজেন্দ্র মাহাতোর বক্তব্য, ‘নতুন সংবিধানে এমনভাবে প্রদেশগুলো ভাগ করা হয়েছে যাতে সাতটির মধ্যে ছটিতেই মদহেশি, থারু বা পাহাড়ি জনজাতিদের ক্ষমতায় আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। যেহেতু ভারতীয়দের সঙ্গে মদহেশিদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে তাই ষড়যন্ত্র করে তাদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতেই এটা করা হয়েছে।’
অত:পর সীমান্ত এলাকায় মদহেশিদের বিক্ষোভে থমকে যায় ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাকের সারি। নেপালে জ্বালানি তেলের পুরো চালানটাই আসে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন মারফত, তাদের সব ট্রাক সীমান্তে আটকে পড়ে।
নেপালের মতে এটা ভারতের অঘোষিত অবরোধ ছাড়া কিছুই নয়, কিন্তু ভারতীয় কূটনীতিকরা তা জোরালোভাবে অস্বীকার করছেন।
নেপালে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রঞ্জিত রাই যেমন বলছেন, ‘ভারত একে নেপালের নিজস্ব রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবেই দেখছে – যার সমাধান নেপালকেই করতে হবে। ভয় দেখিয়ে নয়, বরং হিংসামুক্ত পরিবেশে আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়েই এর সমাধান হতে পারে বলে আমরা মনে করি।’
বিবিসি-র নেপালি বিভাগের গনি আনসারি বলছিলেন, এই জ্বালানি সঙ্কটের কারণেই কিন্তু নেপাল চীনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে :
তাঁর কথায়, ‘এখানে মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ – তারা বলছেন জ্বালানি যদি কিনতেই হয়, তাহলে ভারতের থেকেই কিনতে হবে তার কি মানে? একারণেই নেপাল চীনের সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহের নতুন চুক্তি করেছে, ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত রাস্তা মেরামত হয়ে গেলে পুরোদমে সেই চালান শুরুও হয়ে যাবে।’
কিন্তু ওদিকে মদহেশিদের সঙ্গে সরকারের তিন-চার দফা আলোচনা হয়ে গেলেও দুপক্ষই নিজের অবস্থানে অনড় আছে বলে কোনও ঐকমত্য হচ্ছে না, বলছিলেন মি আনসরি।
নেপালে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জীর মতে, মদহেশিদের সঙ্গে নেপাল সরকার যতদিন না আপস-রফায় পৌঁছতে পারছে ততদিন এই সঙ্কট মেটার আশা নেই।
দেব মুখার্জী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘কাঠমান্ডুর সরকার মদহেশিদের সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নে কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন উঠছে। অতীতের গিরিজাপ্রসাদ কৈরালা সরকার মদহেশিদের সঙ্গে একাধিক লিখিত সমঝোতা করেছিলেন, সেগুলোর সবই নতুন সংবিধানে উল্লঙ্ঘন করা হয়েছে।’
সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রী মোদি যাকে ফোন করে তাঁর অসন্তোষ জানান, সেই নবনির্বাচিত নেপালি প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি ক্ষমতায় আসার ঠিক আগেই আশা প্রকাশ করেছিলেন এই সমস্যা শীঘ্রই মিটে যাবে বলে তাঁর ধারণা।
তিনি বলেছিলেন, ভারতকে বুঝতে হবে নেপাল তাদের বন্ধুপ্রতিম এক প্রতিবেশী। কোনও কারণে দুপক্ষের মধ্যে একটা ভুলবোঝাবুঝি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি খুব বেশিদিন এই ভুলবোঝাবুঝি থাকতে পারে না।
কে পি ওলি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিন সপ্তাহ কেটে গেছে – এর মাঝে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কমল থাপাও দিল্লি ঘুরে গেছেন, কিন্তু সেই ভুলবোঝাবুঝি মেটা তো দূরের কথা, ক্রমশ আরও জটিল আকার নিচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন