বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫ জন ব্লগারকে তাদের লেখালেখির কারণে হত্যা করা হয়েছে। এখন শুধু লেখকই নয়, প্রকাশকেরাও হচ্ছেন হামলার শিকার।
একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটলেও একটি বাদে কোনও মামলারই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি নেই।শনিবার দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশকের উপর হামলার ঘটনায় এই প্রশ্নটিই আবারও সামনে উঠে এসেছে। দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকেই নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দুটির একটি ‘শুদ্ধস্বর’, যার প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজন গুরুতর আহত হন।
একই দিনে রাজধানীর শাহবাগে ‘জাগৃতি’ নামের আরেকটি প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
‘শুদ্ধস্বর’ প্রকাশনীর আহত প্রকাশক নিজেও একজন ব্লগার ছিলেন বলে জানা যাচ্ছে।
একের পর এক হামলার ঘটনা আগের মামলার ধীরগতি বা ব্যর্থতার দিকেই আঙ্গুল তুলে দেয়।
ধারাবাহিক এসব হত্যাকাণ্ডে বিচার কার্যক্রম ঠিক কি পর্যায়ে আছে? ঘটনাগুলোই বা কী ছিল?
আহমেদ রাজিব হায়দার:
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচার ফাঁসীর দাবীতে উত্তাল শাহবাগের আন্দোলন, তখন ১৫ই ফেব্রুয়ারি এই শাহবাগ আন্দোলনেরই এক কর্মী আহমেদ রাজিব হায়দার দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে নিহত হন।
পরে প্রচার করা হয় 'থাবা বাবা' নামে পরিচিত মি.হায়দার ছিলেন একজন নাস্তিক এবং তিনি ইসলাম ও এই ধর্মের নবী মোহাম্মদ সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ ব্লগ লিখতেন।
এই হত্যাকাণ্ডটিই ছিল ব্লগে লেখালেখির অপরাধে বাংলাদেশে প্রথম কোনও হত্যাকাণ্ড।
এই ঘটনায় সন্দেহের ভিত্তিতে সাতজনকে আটক করে পুলিশ এবং তদন্ত শেষে হত্যাকাণ্ডের এগারো মাস পর আদালতে অভিযোগ-পত্র দায়ের করা হয়।
ঢাকায় পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, 'বর্তমানে আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েয়েছে। বিচারিক কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলছে। এই মামলার রায় শীঘ্রই পাওয়া যাবে বলে আশা করছি'।
অভিজিৎ রায়:
অভিজিৎ রায় একজন মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশী।
তিনি মুক্তমনা নামে একটি ব্লগ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যেখানে বিজ্ঞান বিষয়ক নানা লেখালেখি করা হত।
এবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে আসেন তিনি এবং ২৬শে ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে নিয়ে বাংলা একাডেমির বইমেলা দেখে ফেরার পথে আক্রমণের মুখে পড়েন।
হামলায় অভিজিৎ প্রাণ হারান। তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদও মারাত্মক আহত হন।
এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শফিউর রহমান ফারাবী নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ।
ওই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের একটি প্রতিনিধিদল তদন্তের জন্যে ঢাকায় আসে।
পুলিশ বলছে, সন্দেহভাজন হিসেবে মোট ৮ জন হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ওয়াশিকুর রহমান:
অভিজিৎ রায়কে হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মাথায় ৩০শে মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে ঢাকার তেজগাঁও এলাকার একটি সড়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এসময় হামলাকারীদের দুজনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এদের একজন পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাব দেয় বলে জানাচ্ছে পুলিশ।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বা ডিবি মামলাটির তদন্ত করছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মামলায় পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
অভিযোগপত্রে যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তাদের তিনজন কারাগারে আটক রয়েছেন। বাকি দু’জন পলাতক।
মি. রহমানের লেখালেখির অন্যতম একটি বিষয় ছিল ইসলামসহ নানা ধর্মের সমালোচনামূলক প্রসঙ্গ।
অনন্ত বিজয় দাস:
ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয় গত ১২ই মে, সিলেটে। ঢাকার বাইরে এটাই একমাত্র ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।
মি. দাশ বাসা থেকে বের হয়ে একটি ব্যাংকে যাবার পথে হামলার শিকার হন।
তিনি মুক্তমনা নামে একটি ব্লগে লিখতেন এবং সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহের ভিত্তিতে সিলেট থেকে পাঁচজন এবং ঢাকা থেকে দুইজনকে আটক করা হয়।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে রিমান্ডেও নেয়া হয়।
তবে তাদের মধ্যে আটককৃত ইদ্রিস আলী নামে একজন স্থানীয় ফটো সাংবাদিককে সম্প্রতি জামিনে ছাড়া হয়েছে।
সংবাদদাতারা বলছেন, অপর চারজনকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।
এ মামলার আর কোনও অগ্রগতির খবর এখনো জানা যায়নি। মামলাটি এখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি'র অধীনে রয়েছে।
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়:
লেখালেখির অভিযোগে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ সংযোজন নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়।
গত ৭ই অগাস্ট দুপুরে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হয় মি. চট্টোপাধ্যায়কে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি।
মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব ডিবি বা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডই বলছে, নিহতদের দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করা হয়েছে। প্রত্যেককেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
প্রত্যেকটি ঘটনার পরই ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে আসছেন, বিচারহীনতার কারণে দেশটিতে এ ধরণের হত্যাকাণ্ড থামানো যাচ্ছে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন