বাংলাদেশে জাতিসংঘ শিশু সংস্থা ইউনিসেফ-এর 'মিনা মিডিয়া পুরষ্কার ২০১৫'-তে পুরস্কৃত হয়েছেন বিবিসি বাংলার সাংবাদিক ফারহানা পারভিন। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য ফারহানা পারভিন রেডিও বিভাগে মিনা পুরস্কার পান। এই উপলক্ষে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র নিয়ে ফারহানার রিপোর্টটি আবার প্রকাশ করা হলো:
কেন্দ্রগুলোতে যে কেউ চাইলেই ঢুকতে পারে না।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে আমার সুযোগ হয়েছিল টঙ্গীর উন্নয়ন কেন্দ্রে ঢোকার।
চারিদিকে উঁচু দেয়ালে ঘেরা এই কেন্দ্রে ভবনের সংখ্যা তিনটি। এর একটি পাঁচতলা ভবন। যেটি কিশোরদের থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়।
অপর ভবনগুলোতে যথাক্রমে তাদের থাকা ও ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এখানে রয়েছে পড়ার সুযোগ, আর কারিগরি শিক্ষার কিছু ব্যবস্থা।
আপাতদৃষ্টিতে এই কেন্দ্রটি দেখে মনে হতে পারে এটি আর দশটা আবাসিক স্কুলের মতই।
কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে এখানে যেসব শিশু কিশোররা রয়েছে তারা সবাই কোন না কোন অভিযোগে অভিযুক্ত।
তাদের আইনের সংস্পর্শে আনার পর প্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্তদের সাথে না রেখে দেশের শিশু আইন অনুযায়ী রাখা হয়েছে এ ধরনের তিনটি কেন্দ্রে। এদের বেশিরভাগের মামলা রয়েছে বিচারাধীন।
টঙ্গীর এই কেন্দ্রটির আসন সংখ্যা ২০০। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এখানে রয়েছে ৩০৭ জন কিশোর।
তাদের দেখ্ভালের জন্য রয়েছে চারজন কেসওয়ারকার। যারা মূলত তাদের মামলার বিষয়গুলো দেখে থাকেন।
আরও রয়েছেন দুইজন তত্বাবধায়ক। বাকিরা রয়েছেন কেন্দ্রের অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে।
কেন্দ্রটিতে নেই কোনো সার্বক্ষণিক চিকিৎসক এবং মনোচিকিৎসক। এই কয়েকজন কর্মকর্তা দিয়ে আসন সংখ্যার চেয়ে শতাধিক বেশি কিশোরদের দেখ্ভালের কাজটি কীভাবে চলছে?
কেন্দ্রের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ফজলুল রহমান বলছিলেন “কিশোররা কোন সমস্যায় পড়লে কেস-ওয়াকারদের সাথে কথা বলেন। তবে তাদের এখানে থাকার মেয়াদ বেশিদিন না হওয়াতে কাউন্সেলিং-এ খুব একটা কাজ হবে না”।
নানা অভিযোগ কিশোরদের
বাংলাদেশে টঙ্গী ও যশোরে রয়েছে কিশোরদের জন্য কেন্দ্র এবং গাজীপুরের কোনাবাড়িতে একটি রয়েছে কিশোরীদের জন্য।
কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। কখনো অভিযোগগুলো এনেছেন কিশোরদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করেন এমন বেসরকারি সংগঠনগুলো।
কখনো আবার এসব কিশোররা নিজেরাই করেছেন এসব অভিযোগ। বছর দুই আগে এরকম একটি কেন্দ্র থেকে বের হয়েছে একজন কিশোর।
সে সেখানে ছিল দেড় বছর। এই দেড় বছরে সেখানে নানা অনিয়মের কথা উল্লেখ করেছে ছেলেটি।
তবে তার কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক কোন চিকিৎসক না থাকার ব্যাপারটি।
“ওখানে অনেকের শরীরে ঘা-চুলকানি হয়, আবার অনেকে শরীর ব্লেড দিয়ে কাটে অনেক রকম অসুখ বিসুখ হয়। কিন্তু সবসময় ডাক্তার নেই। একটা ডাক্তার আর ওষুধের দোকান অনেক দরকার।”
এই কিশোরটি জানাচ্ছিল ওখানে থাকা কিশোরদের মধ্যে একটা প্রবণতা থাকে সেটা হল নিজেদের শরীর জখম করা।
কয়েকবার তার নিজেরও এমন ইচ্ছা হয়েছে। কারণ হিসেবে সে বলছিল নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছিল তার।
“আমি এমন একজনকে পাইনি যে আমাকে বলবে এইটা করো না, এটা ভাল না। ওখানে খেলার টিচার আছে, সেলাই শেখানোর টিচার আছে কিন্তু আমার ভাল-খারাপ বলার মত কেউ নেই”।
কেন্দ্রগুলোতে নয় বছর বয়স থেকে শুরু করে থাকে ১৮ বছর বয়সী কিশোররা।
এদের বয়সের যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি রয়েছে অভিযোগের মাত্রার তারতম্য।
কারও বিরুদ্ধে রয়েছে হরতালের সময় পিকেটিং-এর অভিযোগ, কারও ছিনতাই, মাদক বেচাকেনা, এমনকী খুনের অভিযোগ পর্যন্ত।
এমন কয়েকজন কিশোরের সাথে আমার কথা হয়েছে যারা এখানে বিভিন্ন মেয়াদে একসময় ছিল।
অনেকে আবার তাদের ভাষায় কেন্দ্রের সিনিয়র ভাইদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল বলে জানিয়েছে।
এমন একটি ছেলের সাথে আমার ঢাকায় দেখা হয়েছিল। সাথে ছিল তার বাবা। ছেলেটির পায়ে অসংখ্য কাটা দাগ।
সে বলছিল কেন্দ্রে থাকা অবস্থায় তার রুমের বড় ভাইয়েরা ছেলেটির অভিভাবকরা যখন দেখা করতে আসতো তখন তাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা, সিগারেট নিয়ে আসতে বলতো।
এর ব্যত্যয় হলেই চলতো তার ওপর নির্যাতন।
নেই কোন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক বা মনোচিকিৎসক
শুধুমাত্র কোনাবাড়ির কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র ছাড়া যশোর এবং টঙ্গীতে সবসময় আসনের চেয়ে সংখ্যায় বেশি থাকে কিশোররা।
যদিও ২০১৩-র শিশু আইনে বলা হচ্ছে বয়স এবং অভিযোগ ভেদে এসব শিশুদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতে কিন্তু এসব কেন্দ্রে বিভিন্ন বয়স এবং বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত কিশোররা একে অপরের সংস্পর্শে আসে কেন্দ্রে থাকা অবস্থায়।
ফলে তাদের মানসিক বা নৈতিক উন্নয়নের সার্বক্ষণিক কোন মনোচিকিৎসক না থাকা এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণের অভাবই এইসব কিশোরদের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন এইসব কিশোরদের নিয়ে বেসরকারিভাবে যারা কাজ করছেন, তারা।
বেশ কয়েকবছর ধরে এসব কিশোরদের কাউন্সেলিং ও এখান থেকে বের হয়ে আসার পর পুনর্বাসনের কাজ করেছে জুভেনাইল ডেলিঙ্কোয়েট ডেভেলপমেন্ট নামে একটি প্রকল্প।
প্রকল্পটির প্রধান ড.এনামুল হক বলছিলেন এসব কেন্দ্র থেকে বের হয়ে বেশিরভাগ তার পূর্বের পেশায় ফিরে যায় বা একই অভিযোগে আবার অভিযুক্ত হয়।
মি. হক বলছিলেন “এদের খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন নির্বাহের জন্য যে অর্থ দরকার সেটা অত্যন্ত কম। তাদের কোন সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। সুতরাং উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক- দে আর হ্যান্ডিক্যাপড্”।
কি বলছে সরকার?
গত ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গীতে বেশ কিছু কিশোর নিজেদের শরীর ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে প্রতিবাদ জানায় কেন্দ্রটির অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনে।
আর সম্প্রতি যশোর কেন্দ্রে সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশদের সাথে সংঘাত হয় কয়েকটি কিশোরের।
ঐ দিনেই সেখান থেকে পালিয়ে যায় দুইজন।
পরে তাদের রুম তল্লাশী করে পাওয়া যায় কিছু দেশি অস্ত্র। এর সপ্তাহ খানেক পর আবারও পালায় ছয়জন।
এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনার প্রশ্নটি আবার চলে এসেছে সামনে।
সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে এসব কেন্দ্র পরিচালিত হওয়ার সমস্যাগুলো নিয়ে অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান পরিচালক জুলফিকার হায়দার বলছেন আইন অনুযায়ী প্রথমত তারা শিশুদের বয়স ভেদে আলাদা রাখা এবং সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মনোচিকিৎসক নিয়োগের ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
“আমাদের কিছু অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে আমরা সবার আগে কাউন্সেলর, সোশ্যাল কেস-ওয়ার্কার পদ বাড়াচ্ছি এবং সেগুলোতে দ্রুত নিয়োগদানের ব্যবস্থা করছি।”
এছাড়া দেশের চারটি বিভাগে আরো চারটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে বলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
আগামী তিন মাসের মধ্যে এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হবে বলে তিনি আশা করেন।
তবে আইন থাকলেও কেন এতদিনে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র গুলোতে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন প্রশ্নে মিঃ হায়দার বলেন এতদিন এ ধরনের সমস্যার মুখে তারা পড়েননি।
একটি কিশোর - আইনের সংস্পর্শে আসার পর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয় তার শারীরিক, মানসিক, ও কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, কিন্তু সত্তর দশকে তৈরি হওয়া এই কেন্দ্রগুলোতে নানা অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছে সেখানে তাদের উন্নয়ন প্রকৃতপক্ষে কতটুকু হচ্ছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন