শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সিয়াচেন দখলে রাখতে গিয়ে সেনামৃত্যু কতটা যৌক্তিক


Image copyrightGetty
Image captionসিয়াচেন পাহারা দিতে গিয়ে কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে প্রাণ দেয় বহু ভারতীয় সেনাসদস্য।
ভারত শাসিত কাশ্মীরের সিয়াচেন হিমবাহে বরফধসের নিচ থেকে আশ্চর্যজনকভাবে উদ্ধার হওয়া ভারতীয় সেনা সদস্য হনুমানথ্থাপ্পা কোপ্পাঢ় আজ বৃহস্পতিবার মারা গেছেন।
পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র বলে পরিচিত সিয়াচেন হিমবাহে প্রায় ২৫ ফিট বরফের তলায় ৬ দিন চাপা পড়ে ছিলেন তিনি। প্রচন্ড ঠান্ডায় দীর্ঘ সময় কাটানোর ফলে তাঁর হাইপোথার্মিয়া হয়ে গিয়েছিল। ফুসফুসে নিউমোনিয়াও ধরা পড়ে। এক এক করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হচ্ছিল।
আজ সকাল থেকে গভীর কোমায় চলে গিয়েছিলেন ওই সেনা সদস্য। দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়।
গোটা দেশের মানুষ যখন মি. কোপ্পাঢ়ের জন্য শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, তখনই প্রশ্ন উঠছে সত্যিই কি এই মৃত্যুর কোনও যৌক্তিকতা আছে?
সিয়াচেন হিমবাহ দখলে রাখতে গিয়ে ১৯৮৪ সাল থেকে এ নিয়ে ৮৮০ জন ভারতীয় সেনা মারা গেলেন। বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়েছে চূড়ান্ত কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে।
অন্যদিকে প্রতি চারদিনে একজন পাক সেনা মারা যান সিয়াচেন পাহারা দিতে গিয়ে।
কারাকোরাম পর্বতের সিয়াচেন হিমবাহ দখলে রাখা নিয়ে দুই চিরবৈরী দেশ ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই শুরু হয় আশির দশকের গোড়া থেকে।
তবে দ্বন্দ্বের বীজ লুকিয়ে ছিল দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া করাচি আর সিমলা চুক্তি দুটির মধ্যেই – যেখানে ‘এন জে ৯৮৪২’ নামের একটি অবস্থানের পরে নিয়ন্ত্রণ রেখা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয় নি মানচিত্রে। মনে করা হত ওই এলাকার আবহাওয়া এতটাই প্রতিকুল, যেখানে কোনও মানুষ থাকতে পারবে না।
“পাকিস্তানি অনুমতি নিয়ে সিয়াচেন হিমবাহে পর্বত অভিযানের সংখ্যা বাড়তে থাকে সাতের দশকের শেষের দিকে। তখনই আমরা খবর পাই যে লন্ডনের একটি দোকান থেকে সিয়াচেন অভিযানের জন্য প্রচুর পোশাক আর সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। পাকিস্তান সিয়াচেন দখলের জন্য তৈরি হচ্ছে। তড়িঘড়ি বিমানবাহিনী আর স্থল সেনা পাঠিয়ে ১৯৮৪ সালে ভারত দখল নেয় সিয়াচেনের,” বলছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত প্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী।
ওই এলাকায় পৌঁছতে পাক বাহিনীর মাত্রই কয়েকদিন দেরী হয়ে গিয়েছিল। ৭৪ কিলোমিটার লম্বা এই হিমবাহের দখল নিয়ে তখন থেকেই দ্বন্দ্ব চলছে দুই দেশের। সিয়াচেন হয়ে উঠেছে পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র।
“সিয়াচেন কৌশলগত কারণেই আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পশ্চিমদিক থেকে পাকিস্তান আর পূবদিকে চীন আমাদের ওপরে হামলা চালাতে পারে। পুরো লাদাখ এলাকাকেই ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারত যদি আমরা সিয়াচেন দখল না করতে পারতাম,” বলছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কে কে গাঙ্গুলি।
Image copyrightMinistry of Defence
Image captionসিয়াচেনে বরফচাপা পড়া ভারতীয় সৈনিকদের উদ্ধার অভিযান
ভারতের দিকে যেমন হিমবাহটি দখলে রাখতে গিয়ে সেনাসদস্যদের মৃত্যু হয় প্রাকৃতিক কারণে, পাকিস্তানের দিকেও মৃত্যুর সংখ্যা কম না। ২০১২ সালে এক বড় বরফধসে একসঙ্গেই ১৪০ জন পাক সেনা সদস্য মারা গিয়েছিলেন।
একটি সাম্প্রতিক হিসাব বলছে ভারতের দিকে গড়ে প্রতি দুদিনে একজন আর পাকিস্তানি বাহিনীতে গড়ে প্রতি চার দিনে একজন করে সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়। আর দুই বৈরী দেশের গোলাগুলির কারণে নয়, বেশিরভাগ সেনাই মারা গেছেন বরফ চাপা পড়ে বা অতিরিক্ত ঠান্ডার মতো চরম প্রতিকুল আবহাওয়ার জন্য।
পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে তাদের চৌকিগুলিতে পৌঁছন তুলনামূলকভাবে সহজ, কারণ তারা হিমবাহের কম উচ্চতার দিকটা দখলে রেখেছে, অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনীকে শুধুই হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পৌঁছতে হয় বেশি উচ্চতায় থাকা এলাকাতে।
এই সেনাসদস্যদের কাছে একেকটি রুটি পৌঁছিয়ে দিতে ভারতের খরচ হয় প্রায় দুশো টাকা, আর পাকিস্তান এক টিন কেরোসিন পৌঁছতে খরচ করে ২০ মার্কিন ডলার। সিয়াচেন দখলে রাখার জন্য ভারত প্রতিদিন এক মিলিয়ান মার্কিন ডলার খরচ করে।
সত্যিই কি প্রয়োজন রয়েছে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার?
জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরীর কথায়, “খরচের তো প্রশ্ন নেই। এটা ভারতের জমি। আমরা কোনওমতেই ছাড়ব না। তাতে খরচ হলে হবে। পাকিস্তানকে তো বহুবার বলা হয়েছে যে নিয়ন্ত্রণ রেখার মানচিত্রে যে ধোঁয়াশা রয়েছে, তা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নিতে। তারা তো করে নি সেটা। আমরা কেন আমাদের জমি ছাড়ব!”
পাকিস্তানেও যেমন সিয়াচেন দখলে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে – সিয়াচেন নামের একটি নাটকের মাধ্যমে সেখানে প্রহরারত সেনাসদস্যদের কঠিন জীবনযাত্রা তুলে ধরা হয়েছে। আবার ভারতেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সিয়াচেনের জন্য এই বিপুল খরচ নিয়ে।
ইনস্টিটিউট অফ পিস এন্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিসের পত্রিকায় একটি নিবন্ধে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গুরমীত কানওয়াল লিখেছেন সিয়াচেন হিমবাহ বা তার আশেপাশের পর্বতশিখরগুলি দখলে রাখার আসলে কোনও কৌশলগত সুবিধাই নেই। সিয়াচেন দখলে রাখতে গিয়ে উল্টে ক্ষতি হচ্ছে, বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভাল করার প্রচেষ্টা।
আর ব্রুকিংস্ ইনস্টিটিউটশনের বিশেষজ্ঞ স্টিফেন কোহেন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিয়াচেন নিয়ে এই দ্বন্দ্বকে বর্ণনা করছেন ''দুই টাকমাথা লোকের একটা চিরুনি নিয়ে লড়াই'' বলে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন