বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ: ফিরে দেখা ২০১৫

    বাংলাদেশে ঘটনাবহুল একটি বছর ২০১৫ সাল।

বছরের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে বছরের আলোচিত সব ঘটনার সংকলন নিয়ে পড়ুন বিবিসি বাংলার বর্ষ পরিক্রমা:
রাজনীতিতে শুরু, রাজনীতিতে শেষ:
বাংলাদেশে এই বছরটা শুরুই হয় প্রচণ্ড রাজনৈতিক উত্তাপ দিয়ে।
এক বছর আগের বিতর্কিত যে নির্বাচনটিতে যোগ না দিয়ে সরকার ব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়ে দেশটির অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, ৫ই জানুয়ারি সেই নির্বাচনের এক বছর পূর্তি পালন নিয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়।
৫ই জানুয়ারি ঢাকায় একটি বড় সমাবেশকে কেন্দ্র করে তার দুদিন আগে থেকে প্রশাসন কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে।
গুলশানের অফিস থেকে বের হতে না পেরে খালেদা জিয়া অব্যাহতভাবে একটি অবরোধ কর্মসূচি চালানোর ঘোষণা দেন।
শুরু হয় দেশ জুড়ে টানা অবরোধ, সহিংসতা।
খালেদা জিয়া গুলশানের কার্যালয়ে দিবারাত্রি অবস্থান করতে থাকেন।
একপর্যায়ে ভবনটি থেকে পুলিশ অবরোধ তুলে নিলেও খালেদা জিয়া সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে অস্বীকৃতি জানান। টানা বিরানব্বই দিন সেখানে তিনি অবস্থান করেন।
পুরো সময়টা বাংলাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ।
বছরের শেষটাও হলো রাজনৈতিক উত্তেজনা দিয়ে।
তবে সহিংসতা নয়, এটা ছিল নির্বাচনী উত্তাপ। বছর শেষ হবার একদিন আগে বাংলাদেশে দুইশটির বেশি পৌরসভায় মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে নামে প্রার্থীরা।
বহুদিন পর এই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির প্রার্থীদের নির্বাচনে লড়তে দেখা যায়।
হামলার লক্ষ্য ভিন্নমত: <span >
<span >২০১৫ সালটি নি:সন্দেহে মানুষের মনে থাকবে বাংলাদেশ-জুড়ে চলা ভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও বিদেশী নাগরিকদের উপর সন্ত্রাসী হামলা এবং এ ধরণের বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের কারণে।
ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি সন্ধেবেলায় ঢাকার বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে ফেরার সময়ে আততায়ীর হামলায় নিহত হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্লগার ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়।
এ ঘটনায় মারাত্মক আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদ।
মি. রায় বাংলাদেশে দ্বিতীয় ব্লগার যিনি ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য খুন হলেন।
                 সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের সামনে এই ফুটপাতেই হামলা হয় অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রীর ওপর।                  
প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালে।
কিন্তু মি. রায়ের হত্যার পর মার্চ থেকে অগাস্ট মাস পর্যন্ত আরো তিনজন ভিন্ন মতাবলম্বী ব্লগার খুন হন বাংলাদেশে।
মার্চ মাসে খুন হন ওয়াশিকুর রহমান, মে মাসে অনন্ত বিজয় দাস, অগাস্ট মাসে নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যয়।
আর অক্টোবর মাসের শেষ দিন এসে ঢাকায় অন্তত দুটি প্রকাশনা সংস্থায় একযোগে হামলা হয়।
প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে অভিজিৎ রায়ের বেশ কয়েকটি পুস্তক প্রকাশিত হয়েছিল।
এদিন জাগৃতি নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার মালিক, ফয়সাল আরেফীন দীপন তার কার্যালয়ে নৃশংস হত্যার শিকার হন।
বিদেশীরাও ছিলেন হামলার লক্ষ্য:
এবছর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের ব্যবধানে অন্তত দুটি হামলায় প্রাণ হারান দুজন বিদেশী নাগরিক।
২৮শে সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার গুলশানে আততায়ীর হামলায় নিহত হন চেজারে তাভেল্লা নামে এক ইতালীয় নাগরিক।
আর ৩রা সেপ্টেম্বর রংপুরে নিহত হন কুনিও হোশি নামে এক জাপানী নাগরিক।
কাছাকাছি সময় আরো কয়েকজন বিদেশী নাগরিকের উপর হামলা হলেও তারা বেঁচে যান।
এই সময়ে বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে বিশ্বের অনেক দেশ।
এমনকি হামলার আশঙ্কায় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিলও করে এই বছর।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা:
                 ইমামবাড়ায় বোমা হামলার পরের দিন হাজার হাজার শিয়া মতাবলম্বী তাদের ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল করে। এদের সাথে যোগ দেয় সুন্নি সম্প্রদায়ের বহু সদস্যও।                 
এই বছর নজিরবিহীন একটি হামলার ঘটনা ঘটে ঢাকায় শিয়া মতাবলম্বীদের পবিত্র দিন আশুরা উপলক্ষে আয়োজিত এক তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে।
ঢাকার পুরনো অংশে ইমামবাড়ায় এই হামলাটি হয় ২৩শে অক্টোবর গভীর রাতে।
বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই একজন নিহত হয়, আহত হয় অর্ধশতাধিক।
যদিও বিশ্বের অনেক দেশেই শিয়া-সুন্নিদের মধ্যেকার বিভেদকে রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় রূপ নিতে দেখা যায়, কিন্তু ঢাকার চারশো বছরের ইতিহাসে কখনো সংখ্যালঘু শিয়া মতাবলম্বীরা কোনও হামলার শিকার হয়নি।
শিয়াদের উপর হামলা ইমামবাড়ার ওই ঘটনাতেই থেমে থাকেনি।
২৬শে নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মতাবলম্বীদের একটি মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে মসজিদের মুয়াজ্জিনকে হত্যা এবং ইমামসহ তিনজনকে আহত করে হামলাকারীরা।
৪ঠা ডিসেম্বর দিনাজপুরের কাহারোলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে শতবর্ষ পুরনো এক মেলায় বোমা হামলা হয়।
আর ১০ই ডিসেম্বর ওই কাহারোলেই কৃষ্ণভক্ত হিন্দুদের আরেকটি মন্দিরে একযোগে বোমা ও গুলি হামলা চালানো হয়।
আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের উত্থান?
বিদেশী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থাপনায় হামলাগুলোর দায় তথাকথিত ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠীর নাম দিয়ে স্বীকার করা হয়।
যদিও এবছর বেশীরভাগ ব্লগার হত্যাকাণ্ডের দায় আল কায়েদার কথিত ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা স্বীকার করে।
অনেক বিশ্লেষকই এই দায় স্বীকারের ঘটনাগুলোকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের এক নতুন মাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেন।
যদিও দেশটির সরকার বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে বাংলাদেশে আইএস সহ যেকোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতির কথা।
অমানবিক নিষ্ঠুরতা:
এবছর অন্তত দুটো নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড মানুষকে নাড়া দিয়ে গেছে।
জুলাই মাসে সিলেটে শিশু রাজন নামে এক শিশুকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার দৃশ্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়বার পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলাদেশের মানুষ।
                 শিশু রাজন হত্যার মূল অভিযুক্ত কামরুল ইসলাম ঘটনার পরই সৌদি আরব চলে গিয়েছিল। তাকে সেখানে আটক করে পুলিশ ও বাংলাদেশের হাতে তাকে সোপর্দ করে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে চলা বিচার কার্যক্রম শেষে কামরুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সিলেটের আদালত।
আর অগাস্ট মাসে খুলনায় রাকিব নামে এক শিশুর মলদ্বার দিয়ে মোটরগাড়ির চাকায় হাওয়া দেয়া নল ঢুকিয়ে বাতাস প্রবেশ করিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে, যা মানুষকে প্রচণ্ড আলোড়িত করে।
নভেম্বর নাগাদই দুটো হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় দেয় আদালত।
এত দ্রুত কোনও মামলার বিচার করাও বাংলাদেশে ছিল নজিরবিহীন ঘটনা।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁ:
এবছর তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে বাংলাদেশে।
এপ্রিল মাসে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় জামায়াত ইসলামীর নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের।
নভেম্বর মাসে একযোগে কার্যকর করা হয় জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড।
সুখবর:
তবে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মাঝেও কিছু ২০১৫ সালটিতে কিছু ইতিবাচক ঘটনার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে।
ক্রিকেটে এই বছর বাংলাদেশ দল যতগুলো একদিনের আন্তর্জাতিকের সিরিজ খেলেছে সবগুলোতেই জয় পেয়েছে।
বাংলাদেশের কাছে পরাজিতের তালিকায় রয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পরাক্রমশালী দল।
এবছরের ছয়ই জুলাই জাতিসংঘ ঘোষিত পনেরো বছর মেয়াদের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজি শেষ হবার পর দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে পূরণ করেছে।
                 ঢাকার কাছে মুন্সিগঞ্জে পদ্মা নদীর উপর এবছরই শুরু হয়েছে মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মান। এই প্রকল্পের পুরো ব্যয় বহণ করবে বাংলাদেশ সরকার, যেটা দেশটির ইতিহাসে নজিরবিহীন।
আর বাংলাদেশে বহু বিতর্ক সৃষ্টিকারী একটি মেগা নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে এই বছরই।
গত বারোই ডিসেম্বর পদ্মা নদীর ওপর ছয় কিলোমিটারেরও বেশী দীর্ঘ এই প্রস্তাবিত সেতুটির মুল অবকাঠামো নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রায় আটাশ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পটির সম্পূর্ণ অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ সরকার, যা দেশটির ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এর আগে এই প্রকল্পটিতে বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার অর্থায়ন করবার কথা থাকলেও সংস্থাগুলো দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে তাদের অর্থায়ন বাতিল করে দেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন