বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে গেলে দেশটির উপকূলের প্রায় তিনকোটি মানুষ বাস্তুহারা হতে পারে, তাদের পুনর্বাসনে অর্থসহায়তার বিষয়ে বাংলাদেশ এবার প্যারিস সম্মেলনে জোর দেবে।
৩০শে নভেম্বর থেকে ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্যারিসে জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবে ইতিমধ্যেই উপকূল থেকে অনেক মানুষ বাস্তুহারা হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে আসছে।
তাদের জন্য এখনই পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা ।
কিন্তু এই বাস্তুহারা মানুষ কোথায় ঠাই পাবেন,তাদের ভবিষ্যত কি দাঁড়াবে,তা নিয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই।
ঢাকার কড়াইল বস্তিতে ঠাঁই হয়েছে বরগুনা জেলার প্রত্যন্ত কুমড়াখালী গ্রামের আলমগীর হোসেন।এই বস্তিতে তার সাথে কথা হয়।বছরখানেক আগে তিনি স্ত্রী-কন্যা নিয়ে এখানে উঠেছেন।
নদী ভাঙ্গনে তিনি বসত এবং কৃষিজমি হারিয়েছেন।তিনি বরগুনায় গরু কিনে রেখে পরে তা বিক্রি তা বিক্রি করতেন।এর লাভের টাকা দিয়ে সংসারে অর্থের যোগান দিতেন।
এক ঝড়ে তার কিনে রাখা পাঁচটি গরুও মরে যায়।ভিটেমাটির পর শেষ সম্বল গরু হারিয়ে তিনি ঢাকা এসে টাকা ধার করে মাছের ব্যবসা করছেন।আর তার স্ত্রী নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবনে ইট ভেঙ্গে কিছু আয় করেন।
দু’জনের আয়ে কোনভাবে তাদের চলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কোন ধারণা নেই আলমগীর হোসেনের।
তবে তিনি জানেন, তার এখন স্থায়ী ঠিকানা নেই।তিনি ভবিষ্যতে এলাকার টানে ফিরে যেতে চান।
আলমগীর হোসেনের মতই ভোলা,পটুয়াখালী,বরিশালসহ উপকূলের বিভিন্ন জেলা থেকে বাস্তুহারা হয়ে অনেকের অস্থায়ী ঠিকানা হয়েছে ঢাকার বস্তি।
এমন কয়েকটি পরিবারের দেখা মেলে ঢাকার কড়াইল বস্তিতে।দিন মজুরির কাজ করে বা রিক্সা চালিয়ে তাদের জীবন চালাতে হচ্ছে।
কিন্তু অনিশ্চয়তা সবসময়ই তাদের তাড়া করছে।
ভোলা থেকে আসা আম্বিয়া বেগমের চোখের সামনে তাদের ভিটা নদীতে চলে গেছে।
অসহায় অবস্থায় তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে ঢাকায় এসে এখন রাস্তার ধারে দু’জনে মিলে পিঠা বিক্রি করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন,জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদী ভাঙ্গন তীব্র হচ্ছে।ভাঙছে উপকূল।ঝড়,জলোচ্ছ্বাস বেশি হচ্ছে।উপরের দিকে উঠে আসছে লবনাক্ত পানি।
আর এসবের ক্ষতির মুখে প্রথম পড়ছে কৃষি বা প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল মানুষ।
একজন স্বাধীন গবেষক ড: আহসানউদ্দিন আহমেদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা শেষ করেছেন কিছুদিন আগে।
তিনি বলছিলেন, শুধু উপকূলের ১৬টি জেলায় নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের হাওড় এলাকাসহ অন্যান্য অঞ্চল এবং নগরগুলোতে।
সরকার এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে যদি সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যায়, উপকূলেরই ১৬টি জেলার প্রায় তিনকোটি মানুষ বাস্তুহারা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামের প্রকল্প পরিচালক এম বি আকতার মনে করেন, একদিনেই এই তিনকোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে না।
কিন্তু ইতিমধ্যেই বাস্তুহারা হয়ে অনেক মানুষ নগরে আশ্রয় নেয়া শুরু করেছে।এখনই পুনর্বাসনের বিষয়ে পরিকল্পনা প্রয়োজন।
তবে বাস্তুহারা হতে পারে, এমন মানুষকে কোথায় আশ্রয় দেয়া যাবে।তাদের জন্য বিকল্প কি হতে পারে।এ ব্যাপারে বা পুনর্বাসনের প্রশ্নে সরকারের নিজস্ব সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা এখনও নেই।
বিদেশী অর্থ সহায়তা পাওয়া যায় কিনা, তার ওপরই সরকার এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নির্ভর করছে।
পরিবেশ বিষয়ক উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব বলছিলেন, প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই পুনর্বাসন প্রশ্নে উন্নত দেশগুলোর সহায়তার বিষয়ে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নেবে।
২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় জরুরি হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০১২ সালের মধ্যে তিন হাজার কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
কিন্তু উন্নত দেশগুলো সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি।
বরং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বা সরকারি প্রকল্পে অন্য ইস্যুতে যে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে,দাতারা সেই সহায়তাকেও জলবায়ু পরিবর্তনের সহায়তা হিসেবে দেখাতে চাইছে।
দশ কোটি ডলারের তহবিল গঠনের ব্যাপারেও উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতির কোন বাস্তবায়ন নেই।
কার্বন নি:সরণ কমানোর প্রশ্নেও উন্নত দেশগুলো সমঝোতায় আসছে না।
অক্সফামের এমবি আকতার বলছিলেন, উন্নত দেশগুলোর আচরণের প্রেক্ষাপটে এবার বাংলাদেশ সরকার এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছু প্রস্তাব নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, উন্নত দেশগুলোর অবস্থান পরিবর্তনের জন্য তাদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
তবে বাংলাদেশ সরকারকে নিজের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে উপকূলের মানুষের জন্য প্রতিবছরই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি মোকাবেলার বিষয় এক নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ড: আহসান উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন,বাস্তুহারা মানুষের জন্য যেমন পরিকল্পনা প্রয়োজন।
দুর্যোগের সতর্কবার্তা ব্যবস্থা উন্নত করাসহ ক্ষতি সামাল দেয়ার অন্যান্য দিকেও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
তবে নদীর ভাঙ্গনে ভিটেমাটি হারিয়ে সম্প্রতি ঢাকার বস্তিতে যারা ঠাঁই নিয়েছেন,তারা বর্তমান সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
তাদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাববার সময় নেই। তারপরও অনেকে জন্মস্থানে ফিরে গিয়ে আবারও ছোট্ট ঘরের স্বপ্ন দেখেন।
কিন্তু সেই স্বপ্ন কখনও বাস্তবে রুপ নেবে কিনা, সেটা তারা জানেনা।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, প্যারিস সম্মেলনে বাংলাদেশ বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনসহ তাদের প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে এবার একটা সমঝোতা প্রত্যাশা করছে।
বিশেষজ্ঞ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বেশি আশাবাদী না হলেও তারা বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন