বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫

ইউরো ও রুবেলের অবমূল্যায়ন ঘটায় ২৫ ভাগ দরপতন ঘটেছে, হাজার কোটি টাকার বাগদা নিয়ে বিপাকে রফতানিকারকরা

 Image result for bagda chingriImage result for bagda chingri
 
আব্দুর রাজ্জাক রানা : বিশ্ব বাজারে ডলারের বিপরীতে ইউরো ও রুবেলের অবমূল্যায়ন ঘটায় ২৫ ভাগ দরপতন ঘটেছে বাগদা চিংড়িতে। সেই সুযোগে বিশ্ব বাজারে চাহিদা বেড়েছে কমমূল্যের উচ্চ ফলনসীল ভেনামী চিংড়ির। ফলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে চিংড়ি রফতানিতে। চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার রফতানিযোগ্য বাগদা চিংড়ি নিয়ে বিপাকে পড়েছে খুলনাঞ্চলের ২৩টিসহ দেশের মোট ৪৭টি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা। এর মধ্যে শুধুমাত্র খুলনাঞ্চলের চিংড়ি রফতানিকারীদের লোকসান গুণতে হবে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা। এতে করে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রতিবছর বাংলাদেশের চিংড়ি রফতানি করে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউরোপ ও রাশিয়া বাংলাদেশের চিংড়ির বড় বাজার। বাংলাদেশের চিংড়ি রফতানি ধাক্কা খায় ২০০৭-০৮ অর্থবছরের বিশ্বমন্দায়। এ সময় আমদানিকারক দেশগুলোতে চিংড়িকে বিলাসী খাদ্য হিসেবে ধরা হয়। তবে, সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে এরপরও রফতানি চলছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুবেল ও ইউরো দুর্বল হয়ে পড়লে সব শেষ ধাক্কা খায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। এ সময় ডলারের বিপরীতে প্রায় ৫৫ শতাংশ দরপতন হয় রুবেলের। আর ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতন হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। ফলে আবারো বিলাসী খাদ্যের তালিকায় চলে আসে চিংড়ি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চিংড়ি রফতানিতে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ববাজারে প্রতি পাউন্ড ১৬/২০ কাউন্টের বাগদার মূল্য ছিল ৯ ডলার বা ৬৯৩ টাকা। সেই থেকে কমতে কমতে বর্তমান বিশ্ববাজারে প্রতি পাউন্ড ১৬/২০ কাউন্টের বাগদার মূল্য এসে দাঁড়িয়েছে ৫ ডলার বা ৩৮৫ টাকায়। এতে করে এক হাজার কোটি টাকার মত অবিক্রীত বাগদা চিংড়ি নিয়ে ব্যাপক লোকসানে পড়েছে বাংলাদেশের ৪৭টি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা। যার মধ্যে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানার সংখ্যা ২৩টি।
বিশ্ব বাজারে চিংড়ি রফতানিতে ধাক্কা খাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে চাষীরা সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করায় উৎপাদন খরচ বেশি হলেও উৎপাদন হারও কম। যদিও এদেশের বাগদা চিংড়ি আমদানিকারক দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়। তথাপি মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুবেল ও ইউরো দুর্বল হওয়ায় বিদেশীদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে বেশি দামের বাগদা চিংড়ি বিলাসী খাদ্য তালিকায় চলে এসেছে। আর নতুন জাতের উচ্চ ফলনসীল ভেনামী নামের চিংড়ি দামে সস্তা হওয়ায় ক্রেতাদের খাদ্য তালিকায় চলে এসেছে। তবে বাংলাদেশে ভেনামী চিংড়ি চাষে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রফতানিকারক রাষ্ট্র ভারত, থাইল্যান্ড ও চীনে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে। ফলে রোগ বালাই সহনশীল এবং উচ্চহারে ফলনশীল নতুন জাতের ভেনামী চিংড়ি বিশ্বব্যাপী বাগদা চিংড়ি খাতে ধস নামিয়েছে। এতে করে চিংড়ি চাষে ও রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। অপরদিকে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন ব্যয় বহুল এবং রোগবালাই সহনশীল নয়। ভেনামী চিংড়ির সাথে পাল্লা দিতে বিশ্বব্যাপী মার খাচ্ছে বাগদা চিংড়ি।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো খুলনা অফিস সূত্র জানায়, গত বছর জুলাইয়ে খুলনাঞ্চল থেকে ৩১ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩ কেজি চিংড়ি রফতানি হয়েছে। আর চলতি বছরের জুলাইয়ে রফতানি হয়েছে ২৭ লাখ ৮২ হাজার ৯০৭ কেজি। গত বছর আগস্টে রফতানি হয় ৩৩ লাখ ৫৯ হাজার ১৯৭ কেজি। চলতি বছরের আগস্টে রফতানি কমে দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭০ কেজি। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে রফতানি কমেছে ১৪ লাখ ৬১ হাজার ৫২৭ কেজি।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি হেক্টরে চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে ৭০০ থেকে ১ হাজার কেজি। থাইল্যান্ডে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার এবং ভিয়েতনামে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কেজি। সেখানে বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি। এ দেশে চিংড়ি উৎপাদন এত কম হওয়ার কারণ হলো, অনেক চাষি সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করছে। ব্যাংক ঋণ না পাওয়া এবং ঋণ পেলেও তা সময়মতো না পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিংড়ি চাষ হচ্ছে না। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও চিংড়ি চাষ হ্রাস পাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বিশ্বের মোট চিংড়ি চাষের মধ্যে ১৪ ভাগ বেড়েছে ভেনামীর চাষ। ফলে বিশ্ব বাজারে দ্রুত বাগদা চিংড়ির স্থান দখল করে নিচ্ছে ভেনামী চিংড়ি। বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্যমতে ভেনামী হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একপ্রকার সাদা চিংড়ি। ২০০০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই চিংড়ি রিসার্চ সেন্টার ‘মা’ ভেনামী চিংড়ি উৎপাদন করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। সম্প্রতি ভারতের চেন্নাইতেও হাওয়াই গ্রুপ একটি রিসার্চ সেন্টার স্থাপন করে ভেনামী ‘মা’ চিংড়ি উৎপাদন করে চলেছে।
২০১৪ সালে ৬০ হাজার বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করে চীনের সাথে তৃতীয় স্থানে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু একদিকে ‘ভেনামী’ চাষ নিষিদ্ধ অন্যদিকে শুধু বাগদা নিয়ে থাকায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। রোগবালাই সহনশীল নয় অথচ ব্যয়বহুল হওয়ায় বিশ্বব্যাপী চিংড়ি চাষিরা বাগদা চিংড়ি চাষ ছেড়ে এখন ভেনামী চিংড়ি চাষে ঝুঁকছে বলে জানা গেছে। পাশপাশি বিশ্ব বাজারে ভেনামী চিংড়ি প্রচুর পরিমাণে মজুদ থাকায় বাগদা চিংড়ির দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। ক্রেতারা ভেনামীর মূল্য দিয়ে বাগদা ক্রয় করতে চায়। তবে সে দামে বাগদা চিংড়ি চাষিদের পোষায় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে ভেনামী চিংড়ি বাংলাদেশের সাগর এবং আবহাওয়ার সাথে অনুকূল নয়। বিচ্ছিন্নভাবে ভেনামীর কালচার নিয়ে আশান্বিত হতে পারছে না চাষিরা। তাদের মতে সরকার পাইলট প্রকল্প নিয়ে ভেনামী চাষের উদ্যোগ নিলে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে একাধিক চিংড়ি রফতানি প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, বিশ্ব মন্দাবাজার এবং সরকারের নগদ সহায়তা প্রদানে বৈষম্যের কারণে ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান চরম হুমকির মুখে রয়েছে। ইতোমধ্যে খুলনাঞ্চলের এ ধরনের ৩৮টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ মাছ শতভাগ কৃষি পণ্য হলেও এর রফতানিতে নগদ সহায়তায় রয়েছে বেশ বৈষম্য। চিংড়ি রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তায় দেয়া হয় ১০ শতাংশ আর মিঠা পানির মাছ বা মৎস্য জাতীয় পণ্যের (শুঁটকি, কাঁকড়া, কুঁচে ইত্যাদি) ক্ষেত্রে ১ দশমিক ১ শতাংশ। এক্ষেত্রে এই নগদ সহায়তার জন্য চিংড়ির সিলিং রেট নির্ধারণ করা হয় প্রতি পাউন্ড ৩ দশমিক ৭৯ ডলার। তাও ২০০২-০৩ অর্থবছরে। যখন এক পাউন্ড চিংড়ির আন্তর্জাতিক মূল্য ছিল ৪-৫ ডলার। গত ১৩ বছরে চিংড়ির দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়। এক বছর আগে ছিল ১০-১১ ডলার। বর্তমান হ্রাসকৃত মূল্যেও ৫ ডলারের বেশি। তবু সমন্বয় হয়নি এ সিলিং। অন্যদিকে মিঠাপানির মাছ বা অন্যান্য মাছের সিলিং রেট হলো প্রতি পাউন্ড ১ দশমিক ১ ডলার। যার প্রতি পাউন্ড রফতানি মূল্য ৫-৭ ডলার। এর মধ্যে যদি ভ্যালু এ্যাড হয় তা ১০ ডলারেরও বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে তাদের নগদ সহায়তার পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ।
এ ব্যাপারে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো খুলনার পরিচালক মো: জাহিদ হোসেন বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি হয়। সেমি ইনটেনসিভ বা আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করে ৪৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন এখন প্রমাণিত। এ ক্ষেত্রে তিনি গাজী ফিসারিজ প্রজেক্টের নাম উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, চাষীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, মাটি ও পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে জমি তৈরি, ভাইরাসমুক্ত সুস্থ চিংড়ি পোনা এবং পরিমিত সুষম খাদ্য দিয়ে আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ পদ্ধতির পাশাপাশি উন্নত চিংড়ি চাষের মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বছরের শুরুতে সময়মতো পোনা অবমুক্তকরণ করা গেলে বছরে দু’দফা চিংড়ি চাষ সম্ভব। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্বেও আমাদের চিংড়ি রফতানির পরিমাণ সামান্য। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সেমি ইনটেনসিভ বা আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদনের সাফল্য সারাদেশের চিংড়ি চাষীদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করছেন। চাষিদের সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে সরকার ই.পি.এফ ফান্ড (প্রান্তিক চাষিদের জন্য লোন ফান্ড) চালু করেছে। এছাড়া চুক্তি ভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে চিংড়ি রপ্তানিকারীদের সাথে প্রান্তিক চাষিদের চুক্তির ভিত্তিতে উন্নত প্রযুক্তির চিংড়ি করা করা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) খুলনার সহ-সভাপতি শেখ মো: আব্দুল বাকী বলেন, বিশ্বে মন্দাভাব এবং সরকারের নগদ সহায়তায় বৈষম্য থাকায় ইতোমধ্যে খুলনাঞ্চলের ৩৮টি ছোট ও মাঝারি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মাত্র ২৩টি কারখানা চালু রয়েছে। তিনি বলেন, সব ধরনের মাছ রফতানিতে অভিন্ন হারে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়ার দাবি আমরা সরকারের কাছে করে আসছি। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সিলিং রেট পুনর্র্নিধারণের দাবিও আমরা জানিয়েছি। না হয় এই বৈষম্য ছোট ও মাঝারি মানের কারখানাগুলোকে রুগ্ন করে তুলবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন