বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রধান তিনটি নদী পদ্মা মেঘনা যমুনা ছাড়াও সরকারি তথ্যে ছোট বড় ৪০৫টি নদীর হিসেব পাওয়া যায়। উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, দখল-দূষণ এবং গতিপথে মানুষের হস্তক্ষেপে বিপন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী। উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী করতোয়াও এখন মৃতপ্রায়।
করতোয়া নদীর সবচে খারাপ অবস্থা বগুড়া অংশে। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা করতোয়াকে বলা হচ্ছে মৃত নদী। উজান থেকে পানির প্রবাহ নেই। দখল আর দূষণে এ নদী জর্জরিত। ৭৩ বছর বয়সী বগুড়ার সাবিদ আলীর অভিজ্ঞতায় এখনো আছে স্রোতস্বিনী করতোয়ার স্মৃতি।
“আমার বিয়া হয় একাত্তরে। তার আগে পরেতো নদী এখানে এ ছিলনা, নদী ভরা ছিল, ঘাট ছিল, পানির সবসময় স্রোত চলিছে। নদীর অনেকটা দখল হয়ে গেছে, আমরা যা দেখিছি তার চেয়ে এমুরো ওমুরো দখল হইচ্ছে। আর আবর্জনাতো আছেই।”
বগুড়া শহর থেকে উত্তরে এগিয়ে গেলে নিকট অতীতেও করতোয়ার প্রশস্ততার প্রমাণ মেলে নদীর ওপর সড়ক সেতু দেখলে। সেতুর নিচ দিয়ে নদীর প্রশস্ত সীমারেখা বোঝা গেলেও নদীতে পানির প্রবাহ জীর্ণ নালার মতো। আর নদীর বুকে অনেক জায়গায় দেখা যায় চাষাবাদও হচ্ছে।
করতোয়ার গতিপথ ধরে আরো এগিয়ে গেলেই ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় এলাকা। আড়াই হাজার বছর আগে এ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে। একটি বেসরকারি সংগঠনের ব্যানারে বগুড়ার করতোয়া নদী রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় কে.জি.এম ফারুক। তিনি বলেন, “জনশ্রুতি আছে যে এখানে সওদাগরী জাহাজ, লঞ্চ এবং বড় বড় নৌকা বজরা যেটা বলে সেটা যাতায়াত করতো। পণ্য পরিবহন হতো এবং ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল বগুড়া। এবং করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে এ সভ্যতা গড়ে উঠেছে।”
মহাস্থানগড় এলাকায় শীলা দেবীর ঘাটে বসে মি ফারুক বলছিলেন, সামাজিক আন্দোলন, আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি করতোয়া রক্ষার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত গেছে তাদের স্মারকলিপি। তিনি বলেন, আশির দশকে কাটাখালী নদীতে বাঁধ এবং স্লুইস গেট বসানোর পর পুরোপুরি শুকিয়ে যায় বগুড়া অংশে করতোয়া নদীটি।
“এ নদী অবৈধ দখল এবং দূষণের সাথে প্রভাবশালী লোকজন জড়িত এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও জড়িত আছে। গাইবান্ধার কাটাখালীতে পরিবেশ বিরোধী যে বাঁধটি দেয়া হয়েছে সে বাঁধটি পুরোপুরি অপসারণ করতে হবে। পুরোপুরি অপসারণ এবং নদীর সংস্কার প্রয়োজন।”
কাটাখালী নদীও অনেক যায়গায় চর পড়ে শুকিয়ে গেছে। ভরা বর্ষাতেও প্রায়ই বন্যার কবলে পড়ে এই জনপদ। নদী তীরবর্তী বাসিন্দা বুলবুলি বলছিলেন, “এদিগি মনে করেন যে এখন শুকোয় যাইচ্ছে (করতোয়া) এখন এ নদীডা (কাটাখালী) থাকিচ্ছে। তা এই নদীডা মনে করেন যে (বর্ষায়) জমিজমা সব কিছু ভাইঙ্গে যাইচ্ছে। তাহলি কেমনে হামরা কী কইরা খামু কও"?
অন্যদিকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের পর কাটাখালী নদীটি আবার করতোয়া নামে প্রবাহিত হয়েছে। করতোয়া নামে এ ধারাটি বাঙালী নদীর সঙ্গে মিশে যমুনায় পড়েছে। গাইবান্ধার মৎস্যজীবী নিজাম উদ্দিন বলেন-“অনেক মানুষ উঠে গেছে। মাছ নাই মাছ কমে গেছে। এই জন্যি উঠে গেছে। আর হামরা যারা আগেথ্থেকেই মাছ মারি, আমরাতো আর অন্য কাজ কইরতে পারবো না। ওই একশ টাকার মাছ হইলেও আছি, দুইশ টাকার মাছ হলিও আছি।”
করতোয়া নদীর উৎস এবং এর গতিপ্রকৃতি জানান নদী গবেষক ড. মমিনুল হক সরকার। স্যাটেলাইট চিত্র দেখিয়ে তিনি জানান, বগুড়া অংশে করতোয়ার কোনো চিহ্ন এখন আর পাওয়া যায় না। “বগুড়ার পাশ দিয়ে যেটা গেছে, সেটার একটা ক্ষীণ ধারা বোঝাটাই খুব মুশকিল, দেখেও মনে হবে না যে এটা নদী হতে পারে। গাইবান্ধায় এসে একটা করতোয়া ভাগ হয়ে গেল দুইটা করতোয়ায়। আবার দিনাজপুরের এদিকে এসে, দিনাজপুরে নিচের দিকে এসে ভারত বাংলাদেশের বর্ডার ক্রস করেছে আবার বাংলাদেশে ঢুকেছে।”
বাংলাদেশে নদী মরে যাওয়ার কারণ নিয়ে মি হক বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই নদীর দিক পরিবর্তন হয় কোথাও শুকিয়ে যায়। তবে মানুষের হস্তক্ষেপে নদীর মৃত্যু তরান্বিত হয়। আর শুষ্ক মৌসুমে উজানে পানি প্রত্যাহার করায় ভাটিতে বাংলাদেশের অনেক নদ নদী শুকিয়ে যায়।
তিনি বলেন,“ভারতেও একটা বাধ আছে যেটা দিয়ে পানি ইরিগেশনের জন্য ডাইভার্ট করা হয়, বাংলাদেশে যেটুকু আছে সেটুকুও যদি পানি ডাইভার্ট করা হয় তাহলে আস্তে আস্তে ডাউনস্ট্রিমে কী হবে? নদী মরে যাবে"।
নদী গবেষক মমিনুল হক সরকার বলেন, নদীর যখন প্রয়োজন অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমেই উজানে পানি অপসারণ করা হয়-“এটা তিস্তার বেলায়ও সত্যি, পদ্মার বেলায়ও সত্যি। ফারাক্কা দিয়ে ড্রাই সিজনেই পানি ডাইভার্ট করা হয়, বর্ষাকালে কেউ করে না। এটা যদি বলতে হয় নদী মরে যাচ্ছে, মরা মানে ড্রাই সিজনেই মরে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমটা যখন আমাদের পানির বেশি দরকার তখনই মরে যাচ্ছে”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন