শনিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৬

প্রেমিকার সঙ্গে মিলতে ভারত থেকে সাইকেল চালিয়ে ইউরোপে

Image copyrightPK Mahanandia

Image captionপ্রথম দেখাতেই দুজনের মধ্যে প্রেম।

তাদের দুজনের প্রথম দেখা হয়েছিল দিল্লিতে শীতের এক সন্ধ্যায়। মেয়েটি অনুরোধ করলো তার ছবি এঁকে দিতে। সেই প্রথম দেখাতেই প্রেম। মেয়েটি ফিরে এল ইউরোপে। ছেলেটি কথা দিল, আবার দেখা হবে দুজনের।
সেই প্রেমের টানেই ছেলেটি একদিন পথে নামলো। প্লেনের টিকেট কাটার মত টাকা নেই। তাতে কী। সব বিক্রি করে একটা সাইকেল কিনলো। সেই সাইকেল চালাতে চালাতে নানা দেশ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল ইউরোপে তার প্রেমিকার কাছে।
অবিশ্বাস্য এই প্রেমকাহিনীর ছেলেটির নাম পি কে মহানান্দিয়া। মেয়েটির নাম শার্লোট ভন শেডভিন। তাদের প্রেম এখনো অটুট। বিয়ে করেছেন। সন্তান বড় হয়েছে। সুইডেনে তাদের সুখের সংসার।
১৯৭৫ সালে শার্লোট ভন শেডভিন প্রথম ভারতে যান। একদল বন্ধুর সঙ্গে দল বেঁধে গাড়ি চালিয়ে ইউরোপ থেকে দিল্লি। এই পথ তখন হিপি ট্রেল নামে পরিচিত। সেখানে তার দেখা পি কে মহানন্দিয়ার সঙ্গে।
মহানন্দিয়া শিল্পী। ছবি আঁকেন। দশ মিনিটে একেঁ ফেলতে পারেন যে কারও অবিকল প্রতিকৃতি।
দিল্লির কনট প্লেসে একদিন শার্লোট গেলেন মহানন্দিয়ার কাছে, অনুরোধ করলেন তার ছবি এঁকে দিতে।
শার্লোটকে দেখে মহানন্দিয়ার মনে পড়ে গেল তার মায়ের করা ভবিষ্যদ্বাণী।

Image copyrightPK Mahanandia
Image captionআফগানিস্তান তখন একেবারেই অন্যরকম এক দেশ।

মহানন্দিয়ার জন্ম ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে। দলিত শ্রেনীর এক দরিদ্র পরিবারে। ভারতীয় সমাজের একেবারে নীচুতলার মানুষ। উঁচু জাতের লোকের কাছে অস্পৃশ্য।
মা তাকে বলেছিলেন, তার ভাগ্যফলে লেখা আছে, একদিন বৃষরাশির এক মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হবে, মেয়েটি আসবে অনেক দূর দেশ থেকে, মেয়েটি সঙ্গীতানুরাগী হবে। মেয়েটি হবে অনেক ধনী, এক বিরাট বনের মালিক।
শার্লোটের জন্মরাশি বৃষ, সুইডেনের এক অভিজাত পরিবারের বংশধর, সঙ্গীতেও তার আগ্রহ আছে। আর তাদের পরিবার সত্যি এক বনাঞ্চলের মালিক।
“আমার ভেতর থেকে কেউ যেন বললো, এই সেই মেয়ে। প্রথম দর্শনেই যেন আমরা পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হলাম চুম্বকের মতো। এ যেন প্রথম দর্শনেই প্রেম।”
শার্লোটকে চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন মহানন্দিয়া। অনেক সংকোচ ছিল তার। কিন্তু শার্লোট যেন এরই প্রতীক্ষায় ছিলেন।
দুজনে বেড়াতে গেলেন উড়িষ্যায়। কোনারক মন্দির দেখে মুগ্ধ শার্লোট।
শাড়ি পরে মহানন্দিয়ার বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন শার্লোট। তাদের উপজাতীয় রীতি মেনে দুজনের বিয়ে হলো। এর পর শার্লোট ফিরে এলেন ইউরোপে। মহানন্দিয়ার কাছ থেকে কথা আদায় করলেন, সুইডেনের বস্ত্র শিল্প শহর বোরাসে দেখা হবে আবার দুজনের।
বছর গড়ালো। দুজনের মধ্যে কেবল চিঠিপত্রে যোগাযোগ। প্লেনের টিকেট কাটার টাকা নেই মহানন্দিয়ার। সব বিক্রি করে দিয়ে কিনলেন একটা সাইকেল। তারপর শুরু হলো প্রেমিকার কাছে যাওয়ার জন্য ইউরোপের পথে মহাযাত্রা।

Image copyrightPK Mahanandia
Image captionশার্লোটের ছবি আঁকতে গিয়ে গিয়ে মনে হলো, এই সেই মেয়ে।

১৯৭৭ সালের ২২শে জানুয়ারি মহানন্দিয়া শুরু করেছিলেন তার এই অভিযান। প্রতিদিন গড়ে ৭৭ কিলোমিটার করে পথ পাড়ি দিতেন।
সত্তরের দশকের সেই সময়টায় দুনিয়াটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। বেশিরভাগ দেশে ঢুকতে তার কোন ভিসা পর্যন্ত লাগেনি।
“তখন আফগানিস্তান ছিল একেবারেই অন্যরকম একটা দেশ। খুবই শান্ত। আর এত সুন্দর। মানুষ শিল্প ভালোবাসতো।”
আফগানিস্তান পর্যন্ত হিন্দি দিয়ে কাজ চালিয়ে গেছেন মহানন্দিয়া। সেখানকার মানুষ মোটামুটি হিন্দি বুঝতো। কিন্তু বিপদে পড়লেন ইরানে ঢুকে।
“তখন আবার আমার শিল্পকর্মই আমাকে বাঁচালো। আমার তো মনে হয় ভালোবাসাই হচ্ছে বিশ্বজনীন ভাষা এবং মানুষ সেটা জানে।”
তার কি ক্লান্ত লাগতো না দিনের পর দিন সাইকেল চালাতে?

Image copyrightPK Mahanandia
Image captionশার্লোট এবং মহানন্দিয়া। সুইডেনে দুজনের সুখের সংসার।

“হ্যাঁ, খুবই ক্লান্ত লাগতো। আমার পা ব্যাথা করতো। কিন্তু শার্লোটের সঙ্গে দেখা হবে, সেই সম্ভাবনা আমাকে উজ্জীবীত রাখতো।”
এভাবে একদিন তুরস্ক হয়ে ভিয়েনা, তারপর সেখান থেকে ট্রেন ধরে গোথেনবার্গ পৌঁছালেন মহানন্দিয়া।
দেখা হলো শার্লোটের সঙ্গে। তবে বিয়ের ব্যাপারে শার্লোটের বাবা-মাকে রাজী করাতে বেগ পেতে হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুইডেনের আইন-কানুন মেনে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হলো তাদের মধ্যে।
৬৪ বছর বয়সী মহানন্দিয়া এখনো সুইডেনেই থাকেন তার স্ত্রী শার্লোট এবং দুই সন্তানকে নিয়ে। কাজ করে শিল্পী হিসেবে।
তিনি সাইকেল চালিয়ে ইউরোপে এসেছিলেন, সেটা শুনে যখন অনেকেই অবাক হয়, সেটা ঠিক বুঝতে পারেন না মহানন্দিয়া।
“ব্যাপারটা তো খুব সহজ। আমি আসলে যা করার দরকার তাই করেছি। ওর সঙ্গে দেখা করতে আসার মতো টাকা ছিল না আমার। তাই আমি সাইকেল চালিয়েছি। প্রেমের টানে। সাইকেল চালানোর প্রতি আমার কোন আকর্ষণ ছিল না।”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন