আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করছেন, ভিন্নমতের বিরুদ্ধে চরম অসহিষ্ণু অবস্থান নিয়ে সরকার কথা বলার স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত করেছে।
তারা আরও বলছেন, সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশে এমন এক ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যেখানে অনেকেই মুক্তভাবে তাদের মনের কথা বলতে পারছেন না।ঢাকার শাহবাগ এলাকায় আজিজ মার্কেটে সৃজনশীল প্রকাশকদের বইয়ের দোকানগুলোকে ঘিরে তরুণ লেখকদের আড্ডা থাকে সারাদিনই।
এমনই একটি আড্ডায় তরুণ লেখক এবং প্রকাশক রুবিন আহসানের সাথে কথা হয়।
সরকার গত তিন সপ্তাহ ফেসবুক যে বন্ধ করে রেখেছিল, তাতে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন।
মি: আহসান বলছিলেন, ``ফেসবুক এখন আমাদের মতা প্রকাশের একটা বড় প্লাটফরম হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরন মঞ্চসহ অনেক সামাজিক আন্দোলন এই ফেসবুকের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। সেটা তিন সপ্তাহ বন্ধ রেখে সরকার আমাদের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করেছিল।”
যদিও ফেসবুক বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপগুলো দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু এখন গণমাধ্যমের কাজে বাধা বেশি আসছে এবং তা দৃশ্যমান নয়।
এটি আরও বেশি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেন দ্য নিউজ টুডে পত্রিকার সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, “এখন দুর্বল গণতন্ত্রের কারণে অদৃশ্য যে বাধা আসছে, তাতে ভয় থেকে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় সেলফ সেন্সরশীপ তৈরি হয়েছে।”
এখনকার পরিবেশ নিয়ে অনেকটা একই ধরণের মূল্যায়ণ দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সুলতানা কামালের। তিনি বলছিলেন, “বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ায় মানুষ এখন ভেবে চিন্তে কথা বলছে। পরিস্থিতির কারণে মানুষ নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে।”
একই সাথে সুলতানা কামাল বলেন, কিছু লিখলে বা কোন কথা বললে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ উঠবে কিনা, এটিও এখন বড় শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি ব্লগার, লেখক, প্রকাশকদের হত্যার ঘটনাগুলোকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল ৭/৮ বছর ধরে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে টকশোতে নিয়মিত অংশ নিয়ে আসছেন। কিন্তু তিনি বলছিলেন, এক বছর ধরে তাকে ডাকা হয়না। এর কারণ তিনি জানতে পারেননি।
তিনি বলছিলেন, সব সরকারের সময়ই বাক স্বাধীনতা সংকুচিত করার চেষ্টা হয়েছে। এখন সেই চেষ্টাটা ভিন্ন ধরণের বলে তিনি মনে করেন।
“আগের সরকারগুলো সমালোচক পত্রিকার সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিতো। এই সরকারের সময় দেখা গেলো, দেশের প্রধান দু’টি পত্রিকায় একসঙ্গে বড় টেলিফোন কোম্পানিগুলো, ব্যাংক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছে কয়েকমাস আগে। এটা সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়।”
তিনি উল্লেখ করেন, তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় সামাজিক নেটওয়ার্কে বা এর বাইরে কারও মন্তব্য নিয়ে যে কোন অজুহাতে তাকে আটক করে রাখা যায় এবং অহরহ এ ধরণের ঘটছে।
আসিফ নজরুলের ধারণা, ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর সরকার নজিরবিহীনভাবে বাক স্বাধীনতার ওপর আঘাত করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামও মনে করেন,এই মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি সবক্ষেত্রেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, “এখন মানুষ খোলামেলাভাবে সরকারের সমালোচনা করতে সাহস পায় না। বিরোধীদলগুলোর ওপর অনেক ধরণের নির্যাতন নেমে আসছে। গণমাধ্যমের ওপর পরোক্ষ চাপ রয়েছে। সমালোচনা ধ্বংসাত্নক রাজনীতিকে উস্কে দিতে পারে, এমন চিন্তা থেকে হয়তো সরকার একটা অবস্থান নিতে পারে।কিন্তু সেটা ভুল।”
বিশ্লেষকরা এটাও বলেছেন, খোলা মনে কথা বলার বা মুক্ত চিন্তার পরিবেশ তৈরি করা না হলে, সেটা সরকার, রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন