বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫

শেখ মুজিবুর রহমান কবে গিয়েছিলেন আগরতলায়?

 
   
                 শেখ মুজিবুর রহমান কবে আগরতলায় গিয়েছিলেন আর কেন তা নিয়ে নতুন কিছু তথ্য রয়েছে 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা' প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কবে গিয়েছিলেন আগরতলায়? কেনই বা তাঁকে সেখানকার জেলে একরাত কাটাতে হয়েছিল?
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে লড়ার জন্য ইংল্যান্ড থেকে টমাস উইলিয়ামসকে কীভাবে যোগাড় করা হল?
‘রোশনারা ব্রিগেড’ই বা কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলির সঙ্গে একটাই নাম জড়িয়ে রয়েছে – তা হল ত্রিপুরা, বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে আগরতলা।
মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকা নিয়ে তৈরি হওয়া প্রথম প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হয়েছে।
ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় বুধবার রাতে আগরতলায় ওই চলচ্চিত্রটি উন্মোচন করেন।
                                     'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা' তথ্যচিত্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন                
কী রয়েছে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা’ ছবিটিতে?
প্রায় আড়াই বছর ধরে এই তথ্যচিত্রটি বানিয়েছেন চিত্র সাংবাদিক রাজু ভৌমিক। তাঁর কথায়, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকা এতটাই বড় আর বিস্তৃত যে একঘন্টার ছবিতে তা তুলে ধরা অসম্ভব। আমরা চেষ্টা করেছি কয়েকটা বিষয়ের ওপরে ফোকাস করতে।“
তথ্যচিত্রের জন্য গবেষণা করেছেন আগরতলার সিনিয়ার সাংবাদিক মানস পাল।
“মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল আমার হাতে আসে – শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক কবে আগরতলায় আসেন। তিনি একবারই এখানে এসেছিলেন, যার সাল তারিখ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন তিনি ১৯৬৩ সালে এসেছিলেন। আমরা খোয়াইয়ের তৎকালীন সাবডিভিশনাল অফিসার স্মরজিৎ চক্রবর্তীর ডায়েরি পেয়েছি, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলায় আসার তারিখ উল্লেখিত আছে।“
সেই ডায়েরিতে ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২ সাল, সোমবার – এই তারিখে ইংরেজিতে যা লেখা রয়েছে তার বাংলা এরকম ‘শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন ব্যক্তি এবং তাঁর সঙ্গে আমীর হুসেন এবং টি চৌধুরী (মনে করা হচ্ছে তারেক চৌধুরী) আসারামবারিতে (খোয়াই আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত) পৌঁছেছেন আজ দুপুর একটায় এবং তাদের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্টেট বা জেলাশাসকের নির্দেশে তেলিয়ামুড়ায় পাঠানো হয়েছে।'
শেখ মুজিবুর রহমান যে সেই যাত্রায় আগরতলায় যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে সমর্থন যোগাড় করতে, সেই খবর পৌঁছেছিল পাকিস্তানি গুপ্তচরদের কাছে।
মি. পাল বলছিলেন, “ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ শেখ মুজিবের আর্জি পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন নেহরুর কাছে। তবে আইএসআই এই খবর জেনে যাওয়ায় তাঁকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর জন্য কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয়েছিল। তাঁকে পুশব্যাক করার আগে নিয়মরক্ষার জন্য একরাত আগরতলায় জেলে রাখতে হয়েছিল।“
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
                 খোয়াইয়ের তৎকালীন সাবডিভিশনাল অফিসার স্মরজিৎ চক্রবর্তীর ডায়েরির পাতা।                
এই মামলার অন্যতম দুই অভিযুক্ত স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান আর আলি রেজা যে বিলোনিয়া দিয়ে ত্রিপুরায় এসে একজন ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা কর্ণেল মেননের [যাঁর আসল নাম কে শঙ্করণ নায়ার বলেই মনে করা হয়, যিনি ভারতের বর্হিদেশীয় গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং এর দ্বিতীয় প্রধান হয়েছিলেন] সঙ্গে শালবাগানে দেখা করে ভারতের সাহায্য চেয়েছিলেন, সেটা অনেকেরই জানা তথ্য।
তবে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে ওই মামলায় মিথ্যা অভিযোগে জড়িয়ে দেওয়ার পরে ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ তাঁর হয়ে বড় ব্যারিস্টার খুঁজতে যে আগরতলার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘জাগরণ’ এর মালিক-সম্পাদক জিতেন পালকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন, সেই প্রায় অজানা তথ্য উঠে এসেছে বুধবার প্রকাশিত চলচ্চিত্রটিতে।
মানস পালের কথায়, “জিতেন পালকে কলকাতায় পাঠানো হয় প্রখ্যাত ব্যারিস্টার ও কমিউনিস্ট নেতা স্নেহাংশু আচার্যের কাছে – যাতে তিনি ঢাকায় গিয়ে শেখ মুজিবের হয়ে মামলা লড়েন। কিন্তু মি. আচার্য রাজি হন নি কারণ তাতে ভারতের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়ে যেত পাকিস্তান। তাই তিনি ইংল্যান্ডে নীরদ সি চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় শেখ মুজিবের হয়ে ঢাকায় মামলা লড়তে আসেন টমাস উইলিয়ামস।“
‘রোশনারা ব্রিগেড’ এর কল্পনা
যুদ্ধ চলাকালীন বেশ কিছু গল্প তৈরি করেছিলেন আগরতলার কয়েকজন সিনিয়ার সাংবাদিক।
“রোশনারা বেগম নামে একজন অতি সাহসী নারী যোদ্ধার গল্প বানানো হয়েছিল, যিনি নাকি বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের সামনে শুয়ে পড়েছিলেন। মাইন ফেটে ওই ট্যাঙ্ক যেমন ধ্বংস হয়েছিল, তেমনই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল রোশনারা বেগমের দেহ। এইসবটাই আগরতলার কয়েকজন সাংবাদিকের বানানো যাতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানো যায়, আর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে এই যুদ্ধে সামিল হওয়া নারী পুরুষের অসীম সাহসের কথা তুলে ধরা যায়, ”ওই তথ্যচিত্রে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন লেখক ও গবেষক বিকচ চৌধুরী। তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’ কাগজের হয়ে যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন নিয়মিত।
তথ্যচিত্রে রয়েছে ত্রিপুরা রাজ্যের তখনকার জনসংখ্যা – ১৫ লক্ষের প্রায় সমান সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়াসহ নানা তথ্য।                
তথ্যচিত্রে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের কথা অথবা কীভাবে রাজ্যের তখনকার জনসংখ্যা – ১৫ লক্ষের প্রায় সমান সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া – এইসব তথ্যও। আরও রয়েছে ত্রিপুরার বিধানসভার বিখ্যাত প্রস্তাব, যেটিতে বাংলাদেশ যুদ্ধকে সমর্থন করা হয়েছিল।
“আমি নিজে যদিও যুদ্ধের ঠিক দশ বছর পরে জন্মিয়েছি ১৯৮১ সালে, তবে আমার বাবা, দাদুরা যুদ্ধের ঠিক আগেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাবার কাছে গল্প শুনতাম যুদ্ধের, পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের। সেইসব ছবি, ত্রিপুরায় শরণার্থী শিবির, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ – এইসবের স্থির চিত্র নিয়ে বছর কয়েক আগে আগরতলায় একটা প্রদর্শনী হয়। সেটা দেখার পর থেকেই প্রামাণ্য তথ্যচিত্র তৈরি করার বিষয়টা মাথায় আসে। তখনই মানসদা আর আমার স্ট্রিপ্ট রাইটার - নাট্যকার সুভাষ দাসের সঙ্গে যোগাযোগ হয়,” বলছিলেন ছবিটির পরিচালক রাজু ভৌমিক।
মি. ভৌমিকের ইচ্ছে রয়েছে আরও যা সব তথ্য যোগাড় হয়েছে, তা দিয়ে পরবর্তীতে আরও দু-তিনটে পর্ব তৈরি করার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন